আরফান হাবিব »
প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কবিদের কবিতায় চিত্রকল্পের প্রকাশরীতি চমৎকৃত করে দৃশ্যানুদৃশ্যের ব্যঞ্জনায়। এই চিত্রকল্প মানববসতির ভেতর থেকে আসে এবং বহন করে চিরন্তনের বার্তা। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কবিরা তাদের কাব্যচর্চার ধারাকে চলমান রেখেছেন। যদিও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা অত্যন্ত আত্মগত জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ফলত সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কবিদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো নয়। তবুও খুঁজে নেয়ার মতো অনেক কিছুই আছে এ পার্বত্য জনপদে। গত শতকের দ্বিতীয় দশকের পূর্ববর্তী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্য ধর্মীয় ও লোকসাহিত্যনির্ভর ছিল। ‘রাধামন-ধনপুদি পালা’ কিংবা ‘গোজেন লামা’র কবিতা ছাড়া আর তেমন কিছুর খোঁজ পাওয়া যেত না। পরবর্তীকালে তিন পার্বত্য জেলার উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট-এর প্রকাশনা বিভাগের কার্যক্রম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কবিদের পথচলায় গতি সঞ্চার করে। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে বেশ কিছু কবিতা সংকলন এবং উৎসবকেন্দ্রিক প্রকাশিত সংকলন এ অঞ্চলের কাব্যচর্চার একটি কাঠামো নির্মাণ করে। ‘রান্যাফুল, বিংশ শতাব্দীর নির্বাচিত কবিতা’ চাকমা কবিতর সমৃদ্ধ কিছু কবিতার সংকলনÑ যা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কবি নিজেদের ভাষায়ও কবিতা লিখেছেন বেশ সাবলীলভাবে। কবিতার শরীরে সংস্কৃতি ও জীবিকা বিষয়বস্তু হিসেবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের কবিদের কবিতায় বহুমাত্রিকতায় প্রকাশিত এবং বিকশিত হয়েছে।
চাকমা রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত। রাজমাতা বিনীতা রায় প্রকাশিত ও কবি অরুণ রায় সম্পাদিত ‘গৈরিকা’ পত্রিকা যা ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির প্রথময় সংখ্যায় চাকমা কবি চুলীলাল দেওয়ান (১৯১১-১৯৫৫)-এর ‘চাকমা কবিতা’ নামক একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। যার মধ্য দিয়ে এ জনপদের কাব্যচর্চায় একটি নতুনধারার সূত্রপাত করে।
চাকমা কবিদের মধ্যে মৃত্তিকা চাকমা (জন্ম ১৯৫৮) অন্যতম উজ্জ্বল নাম। কাব্যচর্চার ধারাবাহিকতা তাঁকে এ অঞ্চলের কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য করে রেখেছে। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘মনপরানী’ (২০১৩), ‘এখনো পাহাড় কাঁদে’ (২০১১), ‘মেঘ সেরে মোনোচুক ’(২০১২), ‘গঝক’ (২০২২) বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। সমসাময়িক জীবন তাঁর কবিতায় প্রধান্য পেয়েছে। নিজেদের ঐতিহ্যগত পরম্পরাকেও তিনি নিপুণভাবে নিয়ে এসেছেন কবিতার পটভূমিকায়। ফলত তাঁর কবিতা অরণ্য জনপদের গন্ধমাখা আধুনিকাতাস্পর্শী। ‘মাটি ও জীবন’ কবিতায় আমরা কবির একান্ত অনুভবের মানচিত্রগত পরিচয় প্রকাশিত হতে দেখিÑ
বিচরণ করতে ইচ্ছে করে বাসনার প্রখরতায় :
হিমালয়ের পাদদেশে আছড় ফেলি
সম্মুখে যত বাঁধন হোক
কারণ শক্তিরা আলিঙ্গন করে প্রেমে
আমি ভয়ার্ত নই বিয়েত্রার সাথে আমার দেখা
সোচ্চার হয় পাখিরা এবং সমস্ত ধরণীর জীব
উড়ে যায় পায়রা থেমে যায় ভূপৃষ্ঠ
আবার ভালবাসা বৃদ্ধি হয় মাটি ও জীব এবং
বাসনাগুলো তৃপ্তি হয়ে উঠে মহা আনন্দে। (এখনো পাহাড় কাঁদে)
পার্বত্য চট্টগ্রামের আশির দশকের খ্যাতিমান কবিপ্রতিভা মৃত্তিকা চাকমা। তাঁর জন্ম রাঙ্গামাটির বন্ধুকভাঙা মৌজার মুগাছড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত চাকমা পরিবারে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে বাস্তুভিটা হারিয়ে পরিবারের সঙ্গে শৈশবে উদ্বাস্তু হন তিনি। ফলে তাঁর কবিতায় প্রকৃতির পাশাপাশি দ্রোহের উচ্চারণ এসেছে বারবার। তাঁর ‘হৃদয়ে পাহাড় কাঁদে’ কবিতার শেষ পঙক্তি তুলে ধরা হলো :
আমি কবুল করেছি এ বিঝুতে আমি যাবো না
অর্ধ লক্ষ মা-বাবা-ভাইবোন
আত্মীয়স্বজনের প্রেক্ষিতে, ক্ষতবিক্ষত পাহাড়।
(হাফিজ রশিদ খান সম্পাদিত ‘অরণ্যের সুবাসিত ফুল’ থেকে। প্রকাশকাল : ২০০৯)
মৃত্তিকা চাকমার কবিতায় স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের নান্দনিক সৌন্দর্যের কথা ফুটে উঠেছে। তিনি চাকমা সাহিত্য সমাজকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে। কবিতা নিয়ে তাঁর বসবাস। দেশপ্রেমের অনন্যতাও তাঁর কবিতায় ধরা পড়ে। কবির ‘একাত্তরের পাহাড়’ কবিতার পঙক্তি গুলো নিম্নরূপ :
ক্ষুদিরাম সূর্যসেন প্রীতিলতা জেগে উঠ
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ফিরে আসছে
বাংলার সিংহাসন অবরুদ্ধ
শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্ত হতে চাই মুক্ত আকাশে।
টিক্কা খানের লেজ ঝরে গেল
জুলফিকার পালালো পরাজয়ের মালা নিয়ে
একাকার হয়ে গেল বাংলার আকাশ সীমা
মানবজাতি জেগে উঠলো বসে নেই গোলাম হোসেন
প্রকম্পিত হয়ে উঠলো শেখ মুজিবের রণহুঙ্কার
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। (রান্যাফুল, ২০০৬)
বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অরণ্য ও পাহাড়ের সমবায়ে গড়ে উঠেছে। এখানে চলমান নগরায়ণের ছোঁয়া লাগলেও অধিকাংশ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী তাদের প্রকৃতিলালিত ঐতিহ্যবাহী ও পরম্পরাগত জীবনধারাকে বহন করে চলেছে আজও। ফলত এ জীবনের প্রতিভাস তাদের গীতিগুচ্ছ ও কবিতায় খুব স্বাভাবিক দাবিতেই অস্তিত্ববান। বলাবাহুল্য, অস্তিত্বের এই সৌন্দর্য এখানকার প্রাকৃতিক বাস্তবতার অভিন্ন প্রকাশক ও উদ্দীপক। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার বাসনা থেকে কবি তাঁর ‘আমার মৃত্যু পরে’ কবিতার প্রথম স্তবকে নিজের মনোভাব প্রকাশ করেছেন এভাবে :
আমার মৃত্যুর পরে হারিয়ে যাবো ঐ দূর নীলিমায়
তারকার ঝিলিমিলি উর্মিমালায় থাকব সে ক্ষণে;
দেখবে জ্যোৎস্নার ঝলমলে আলোয়
বসবে অজস্র পাখ-পাখালির মেলা
ছায়াপথে হেঁটে যাবো রাত্রিতে সারাবেলা।
(হাফিজ রশিদ খান সংকলিত সম্পাদিত ‘অরণ্যের সুবাসিত ফুল’ গ্রন্থ থেকে। প্রকাশকাল ২০০৯)।
কবি তাঁর কবিতায় বৌদ্ধ জন্মান্তরবাদ ও পুনর্জন্মের কথা কল্পনা করেছেন। কবি নীলিমায় হারিয়ে যেতে চান, আকাশভরা তারার আলোতে মিশে যেতে চান, গ্রহনক্ষত্রের ছায়াপথে হেঁটে গিয়ে অনিবার্য মৃত্যুকে জয় করতে চান। জীবন ও জগতের রূপান্তরবাদ, সমাজজীবনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা অসহনীয় জীবন- জীবিকার প্রতি বহুমাত্রিক চেতনার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর কবিতায়। মৃত্তিকা চাকমার কবিতায় দ্রোহের প্রসঙ্গ বেশ প্রাসঙ্গিকভাবে উচ্চারিত। তবে প্রকৃতি ও প্রেমকে তিনি ধারণ করেছে সমান ধারায়। তাঁর ‘পাহাড়ে মৃত্তিকার ভালোবাসা’ কবিতায় দেখি এর সফল উচ্চারণ :
পাহাড়ে মৃত্তিকার সন্তান। নিমগ্ন নিদ্রা
স্খলিত হচ্ছে, জোড়া নেই
স্খলিত হচ্ছে, জোড়া নেই
অনিবৃত্ত সরলতা জড়ো হয়, সবুজ গুল্ম
ঘুমপাড়ানির তৃণে ঢেলে দিই সব।
জারজ জন্ম নিচ্ছে, পাফেলছে মৃত্তিকায়
অঙ্গরী চিহ্ন সমাগত তাই পেছনে গমন
পাহাড়ের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে
কেন এমন হচ্ছে? ইতিহাস বিলুপ্ত করছি।
জাতীয় অঙ্গীকারানামা পালাতে
কথা ছিল শুভ্র পায়রা ছিটানো
পাহাড়ের মৃত্তিকার ভালোবাসা।
(পার্বত্য চট্টগ্রামের বিংশ শতাব্দীর নির্বাচিত কবিতা, ২০০৮)
মৃত্তিকা চাকমার কবিতায় একটি বিশেষ দিক হলো প্রেম কিংবা প্রকৃতি যে বিষয়ই হোক না কেনÑ মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর বেশ চাপাস্বভাব। তাই তাঁর কবিতাগুলোকে পাহাড়ের মতো রহস্যময় করে রেখেছে। প্রকাশরীতি সহজ-সরল, কিন্তু কী যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন একটি ব্যাপার প্রায় প্রতিটি কবিতাজুড়ে। যেমন:
ঝিরি অবদমিত ভূমি রসহীন
গুপ্তধনের বসত।
একের পর এক পাহাড়, উঁচু পর্বত পথচলা
সেথায় পরিপূর্ণতায় ভরে আছে বনবৃক্ষরাজি
ছড়ার পর ঝিরি পাহাড়ের পাদদেশে
রয়েছে হাজার যুগ
পাথর, সে পাথরের ক্ষয় নেই। (গঝক, ২০২২)
কবিতাকে জীবনের কেন্দ্র করা গেলে আমাদের জীবনযাপন অন্যরকম হতো। কিন্তু তা সব সময় হয়ে ওঠে না। কবি মৃত্তিকা চাকমার কবিতায় সরলতা এবং আখ্যানের এক অদ্ভুত বিক্রিয়ার চিত্র উঠে এসেছে বারবার। শিথিল বাঁক এবং বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কবিতার বোধ সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। কোনো জড়তা নেই, কোনো বিপত্তি নেই পথচলায়। কবি যেন জানেন ঠিক কোথায় তিনি পৌঁছাতে চান, কোন পথ ধরে। কবির গতিবিধি সর্বব্যাপিত, অর্থবোধক। চারপাশের পরিচিত প্রকৃতির টুকরো টুকরো ইমেজকে ব্যবহার করে কবি কবিতায় বলেছেন নিজের জাতিসত্তার কথা।
নদী-পাহাড়ঘেরা যে জীবন, তাতে মানুষের সংগ্রাম, মানুষের প্রত্যাশা ও জীবনধারণের নানা উপাদান গচ্ছিত আছে। কবিতা সেখান থেকে সংগ্রহ করে উপাদান ও চিন্তা। নদীকে ঘিরে আছে অনেক দুঃখ। সীমান্তের নদীগুলোর চেহারা আরো ভয়াবহ। আবার নদীগুলোতে নেই তেমন কোনো সরকারি নজরদারি, রক্ষণাবেক্ষণেরও অভাব চোখে পড়ে। অনাদরে পড়ে থাকা অথচ সকলের প্রয়োজনে বড় বেশি বন্ধুর মতো আচরণ করে পাহাড়ি নদীগুলো। আর বহর করে চলে চিরায়ত আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি ও ক্ষোভের কথামালা। ‘লোগাঙ’ নদীকে নিয়ে রচিত একটি কবিতা দেখে নিতে পারিÑ
জায়গার নাম হিল চাদিগাঙ
যে দিকে যাই দেখি শুধু নদ-নদী
আর নদ-নদীতে শুধু বন্যা আর বন্যা
যেখান থেকে একটি নদী তার নাম লোগাঙ।
পাহাড়ি নদীর কোনো সুখ নেই
কোনো নদের ছড়া নেই
আর রক্ত নেইÑ রক্ত নেইÑ রক্ত নেই
কোনো নদীর বাধ নেই।
যেতে যদি চাও তবে চলে যাও
সবকিছু ছেড়ে ওখান থেকে চলে যাও
এখান থেকে চলে যাও। (নদীর নাম লোগাঙ)
এ কবিতায় প্রকৃতির বিচিত্র দিক খুব সফলতার সঙ্গে কবি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। কবি মৃত্তিকা চাকমা জীবনবাদী শিল্পী। হতাশা ও প্রাপ্তির তথ্য পরিবেশিত হয়েছে আলোচ্য কবিতায়। কবিতার শরীর নির্মাণে তিনি হয়েছে বাস্তববাদী। জীবন এবং জনপদবিমুখতার সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে তাঁর কবিতা পাঠকের মনোজগতে সহজেই প্রশ্ন তৈরি করতে পারে। এজন্য হয়তো গিরিকবি অভিধা তাঁর জন্য যত্ন করে তুলে রাখা যায়।
আধুনিক মানুষের জীবনে দেখা বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য এবং সীমাহীন জটিলতার স্পর্শ কবি মৃত্তিকা চাকমার কবিতায় তেমনি একটি স্থান পায়নি। সাধারণ জীবনের প্রবল প্রভাব ও প্রতাপ তাঁর কবিতাগুলোকে করেছে পদ্মপাতার শিশিরে হেসে ওঠা প্রভাতের সম্পূর্ণ সূর্যের মতো। তেজহীন ও স্নিগ্ধ। পুঁজিবাদী সভ্যতার অভ্যন্তর সীমাবদ্ধতার চাপ ও সময়ের শাসন কবি তাঁর কবিতায় উপমা হিসেবে স্থান দিয়েছেন এবং কবি মৃত্তিকা চাকমা এখনো মৃত্তিকা সংলগ্ন হয়ে শুনিয়ে যাচ্ছেন ঝরনা ও নদীর সমুদ্রসম্ভব বর্ণিল যাত্রার গান।