সুপ্রভাত ডেস্ক
দেশে খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৫৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তির বিপরীতে ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ ছিল ৯২,২১১ কোটি টাকা। অথচ এসব মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে আদায় হয়েছে ২৩,৩২৮ কোটি টাকা, যা মোট পাওনার মাত্র ২৫ শতাংশ। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জামানতের ওভার ভ্যালুয়েশন (অতিরিক্ত মূল্যায়ন) ও নানান অনিয়ম-জালিয়াতিকে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের পথে অন্যতম বাধা হিসেবে দেখছেন ব্যাংকাররা।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৮,০১৪ কোটি টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এরপরে রয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৩১,০৩১ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহক মারা যান, তখন বাস্তবতার কারণে জামানত হিসেবে যা পাওয়া যায়, তা দিয়েই মামলা নিষ্পত্তি করা হয়। এছাড়া, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তখন ব্যাংক যেটুকু পুনরুদ্ধার করতে পারে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। খবর টিবিএস।
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক যোগাসাজোশ থাকে। তারা ঋণের বিপরীতে যে জামানত নেয় দেখা যায় তার মূল্য ঋণের তুলনায় খুবই কম। এছাড়া, একই জামানত বারবার ভ্যালুঅ্যাডিশন করে অতিরিক্ত মূল্য দেখায়। এরপর যখন ঋণ খেলাপি হয়ে যায়, তখন আদায় করতে গিয়ে ঋণের আসলও আদায় করা যায়না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা বেড়েছে ৩৫১টি; একইসঙ্গে এসব মামলায় দাবিকৃত টাকার পরিমাণ বেড়েছে ১১,৩৯১ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭২,৫৪০টি; একইসঙ্গে এসব মামলায় দাবির পরিমাণ রয়েছে ১,৭৮,২৭৭ কোটি টাকা। বর্তমানে অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার বিপরীতের সবচেয়ে বেশি ৭৫,৯৭৩ কোটি টাকা আটকে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর আটকে ২,৪৪৮ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৯৫,৯৩৬ কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৩,৯১৮ কোটি টাকা আটকে আছে। ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থঋণ আদালতে ব্যাপক অঙ্কের টাকার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, কিন্তু আদায় হয়েছে খুবই কম। এখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালো গ্রাহককে ঋণ দেয় না। যার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুদিন পর খেলাপি গ্রাহক হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে জামানত (মটগেজ) রাখা হয় তার অরিরিক্ত মূল্য ধরা হয়। কিছুদিন পর অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যায় কিংবা মারা যায়, তখন আর ঋণ আদায়ের সুযোগ থাকে না। সে যেই মটগেজ রেখে যায়, তা বিক্রি করেও দেখা গেছে নাম মাত্র অর্থ আদায় হয়।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালত গঠন হওয়ার পর ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ আদালতে মামলা হয়েছে ২,২৮,৪১৮টি। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ছিল ২,৭০,৪৮৮ কোটি টাকা।
যদিও ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা ছিল ২,২২,৩৪৮টি। সে সময়ে এসব মামলার বিপরীতে দাবিকৃত টাকার পরিমাণ ছিল ২,৪৯,১৮৪ কোটি টাকা।
অর্থঋণ আদালতের হিসাব ব্যতীত দেশের ব্যাংকগুলোর ২০২৩ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রয়েছে ১.৩১ হাজার কোটি টাকা। যদিও ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ১.২০ হাজার কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্রাহকের ঋণের সুদ বেড়ে যতগুণই হোক, আদালতের কাছে তিনগুণের বেশি দাবি করা যায় না। এছাড়া অনেক খেলাপি ঋণের মামলার ডকুমেন্টেটেশন ঠিকমতো করা হয়না, যার কারণে আদালত এসব মামলা নিষ্পত্তি করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় জামানতের বেশি ভ্যালু অ্যাড করে। তারপর আদালতের মাধ্যমে নিলামে তুললে দেখা যায় সেই সম্পতির মূল্য অনেক কম। সেক্ষত্রে মূল ঋণের চেয়ে অনেক কম অর্থ পাওয়া যায়।’
এদিকে কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণ নিয়ে হাইকোর্টে রিট মামলা রয়েছে ১০ হাজারের বেশি। এর মাধ্যমে অনেকেই আদালত থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন। ফলে এসব ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে টাকাও ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংক, আবার ঋণ খেলাপির তালিকায়ও তাদের নাম উল্লেখ করতে পারছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী ব্যাংকগুলো অর্থ আদায়ে চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে যদি ঋণগ্রহীতার পর্যাপ্ত জামানত রাখাও না হয়, তবুও ঋণগ্রহীতাকে অর্থ পরিশোধ করতে হবে।