আয়েন উদ্দিন »
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ হবে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে দ্রুতগতিতে।
পুলিশ লাইনে গিয়ে দেখা যায়, ব্রিটিশ নির্মিত পুরাতন অস্ত্রগারের লাল দালানটির অবকাঠামো ঠিক রেখেই ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ চলছে। ঐতিহাসিক এই লাল দালানটির সামনে পোড়ামাটির ফলকে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য খুদিত হয়েছে। যাদুঘরটির ভিতর চলছে ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ।
বাঙালির দীর্ঘ বীরত্বের ইতিহাস সংরক্ষণে এ কাজ করছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ। জাদুঘরটির নাম রাখা হয়েছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর।’ নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনসে তৎকালীন ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রাগার ও ব্যারাক সংরক্ষণ করে তৈরি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চট্টগ্রাম’।
যা থাকছে যাদুঘরে
১৬ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এ জাদুঘরে তৎকালীন ব্রিটিশ স্থাপত্য ঠিক রেখেই সংস্কারের কাজ চলছে। তবে পুলিশ ব্যারাকের পেছনে একটি স্থাপনা তৈরি করে এর আকার বাড়ানো হচ্ছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবীদের ভূমিকা জনগণের কাছে তুলে ধরতে সে জাদুঘরে মাস্টারদার ফাঁসির মঞ্চের আদলে একটি রেপ্লিকা তৈরি করা হবে; রাখা হবে বিপ্লবীদের ছবি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদ্যদের ভূমিকার কথাও সংরক্ষণ করা হবে এ জাদুঘরে। সাথে থাকবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী পুলিশ সদস্যদের স্মৃতিও। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পুলিশ বাহিনীর যে ৮১ জন সদস্য চট্টগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তার ইতিহাসও তুলে ধরা হবে। জাদুঘরের সীমানা প্রাচীরে ৮১ পুলিশ সদস্যের নাম লেখা থাকবে। পাশাপাশি নতুন করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির পরিকল্পনাও আছে। এ জাদুঘরে থাকবে একটি বঙ্গবন্ধু কর্নার, সেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের চট্টগ্রামের অংশটির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক, তথ্য ও চিত্র থাকবে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই অস্ত্রগারের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। স্বাধীনতা দিবসের আগে এ জাদুঘর সবার জন্য উন্মুক্ত করার আশা প্রকাশ করেছেন তারা।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রামের দামপাড়ার পুলিশ ব্যারাক ও অস্ত্রাগার দখল করে নেন।
মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, পুরনো অস্ত্রগারের আদল ঠিক রেখেই সংস্কার করা হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত করা হচ্ছে তৎকালীন পুলিশ ব্যারাকটিও। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত এ অস্ত্রাগারটি প্রায় ৯১ বছর পর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাতে একাধিক সরকারি স্থাপনায় বিপ্লবীদের অভিযানের পর চারদিন ‘স্বাধীন’ ছিল চট্টগ্রাম। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদার নেতৃত্বে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ দামপাড়ার এই অস্ত্রাগার, পাহাড়তলীর রেলওয়ে অস্ত্রাগার, নন্দনকান টিঅ্যান্ডটি অফিসসহ একযোগে একাধিক স্থানে হামলা চালায়।
ব্রিটিশ পুলিশের সেই অস্ত্রাগারসহ সব স্থাপনা সফলভাবে দখলের পর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান নেন বিপ্লবীরা। এরপর ২২ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাধীন ছিল চট্টগ্রাম। দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সেই প্রথম বিজয় পতাকা উড়েছিল চট্টগ্রামে। সেই ঘটনায় করা মামলায় মাস্টারদার সন্ধান চেয়ে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। পরে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসি দেওয়া হয়। চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত কোনো জাদুঘর এখনো নেই।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ দামপাড়া পুলিশ লাইনস আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। সম্মুখযুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ দামপাড়া পুলিশ লাইনস আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। সেই পুলিশ লাইনসই ৪১ বছর পর বাঙালির ইতিহাসের আরেক ঘটনার সাক্ষী হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে চট্টগ্রামে পুলিশ বাহিনীর ৮১ সদস্য শহীদ হন।
‘ইতিহাসের খসড়া’র সম্পাদক ও গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক সুপ্রভাতকে বলেন, চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন যারা তাদের মধ্যে ছিলেন দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের রেঞ্জ ইন্সপেক্টর আকরাম হোসেন, কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল খালেক, তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এম শামসুল হক, দুর্নীতি দমন বিভাগের উপপরিচালক নাজমুল হক প্রমুখ ।
তিনি আরো বলেন, ৫০ বছর পরে হলেও এ যাদুঘরটি নতুন প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করবে। তারা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস জানতে পারবে।
এ মুহূর্তের সংবাদ