নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার দশম বার্ষিকী পূর্ণ হলো ২৯ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সালের এদিন রাতে কক্সবাজারের রামুতে আলোচিত সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছিল। ফেসবুকে উত্তম বড়ুয়া নামের এক যুবকের আইডিতে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননাকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে ধ্বংস করে রামুর ১২টি বৌদ্ধবিহার ও ৩৪টি বসতঘর। পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর অগ্নিসংযোগ করা হয় উখিয়া ও টেকনাফের আরও সাতটি বৌদ্ধবিহার ও হিন্দু মন্দিরে। এ ঘটনায় ১৯টি পৃথক মামলা করা হয়। এর মধ্যে আপসে একটি মামলার নিষ্পত্তি হলেও বাকি ১৮টি মামলার একটিরও বিচার সম্পন্ন হয়নি।
হামলার ১০ বছর পার হলেও এখনো পর্যন্ত একটি মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় বিচার নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা। তারা বলেছেন, এখন বিচারের নামে নিরাপরাধ কোন ব্যক্তি হয়রানি হোক তা চান না তারা। তারা চান শান্তি ও সম্প্রীতি।
অনেকেই বলেছেন, প্রভাবশালী আসামিরা জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকাশ্যে। তাদের ভয়ে মামলার সাক্ষীরা আদালতের চৌকাঠ মাড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় থেমে আছে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনায় করা ১৮ মামলার বিচার। ঘটনার দশ বছরেও হামলাকারীরা বিচারের মুখোমুখি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ এ সম্প্রদায়ের মানুষ।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের ঘটনার পর পুলিশ বাদি হয়ে এজাহারভুক্ত ৩৭৫ জন এবং অজ্ঞাত আরও ১৫/১৬ হাজারজনকে আসামি করে ১৮টি মামলা করে পুলিশ। পরবর্তীতে এসব মামলায় প্রায় ১ হাজারেরও বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা কেতন বড়ুয়া জানান, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে রামুতে মিছিল, মিটিং হয়েছে। অনেকেই চেনা গেছে। কিন্তু মামলার পরবর্তী যে প্রক্রিয়া তাতে অনেক চিহ্নিত ব্যক্তি যেমন বাদ পড়েছে তেমনি নিরাপরাধ অনেকেই হয়রানি হতে দেখা গেছে। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির। এখন সকলেই শান্তি চান, যে সম্প্রীতিতে রামুবাসী বসবাস করছে তা যে রক্ষা হয়।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা বিপুল বড়ুয়াও বলেছেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘ঘটনার ১০ বছরে এসে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ ভুলতে বসেছে। পুড়িয়ে দেয়া বিহার নান্দনিকভাবে নির্মিত করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শান্তিতে আছি, সম্প্রীতিতে আছি। এর চেয়ে বেশি পাওয়ার নেই।’
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক ভিক্ষুক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানান, আলোচিত এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা ঘুচিয়েছে। এটা ধারাবাহিক রক্ষা করা জরুরি। বিচারের নামে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা জরুরি। এটা করতে গিয়ে নিরাপরাধ কেউ হয়রানির শিকার হোক তা কোনভাবেই কাম্য নয়।
কক্সবাজার জেলা দায়রা ও জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, ওই ঘটনায় মামলা হয়েছিল ১৯টি। এরমধ্যে পুলিশ বাদি হয়ে ১৮টি মামলা করেন। অপর একটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি বাদি হয়ে মামলা করলেও পরবর্তীতে বিবাদিদের সঙ্গে আপসনামা দিয়ে খালাস করেছেন। বিচারাধীন ১৮টি মামলায় সাক্ষী না পাওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘসূত্রতা।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইন কর্মকর্তা জানান, মামলায় কোনভাবেই সাক্ষীরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিতে রাজী হচ্ছে না। ফলে মামলা নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রকট হচ্ছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতাও সাক্ষ্য দিতে বা হাজির হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছে না।
এদিকে, এ ঘটনার ১০ বছরে এসেও সেই উত্তম বড়ুয়ার কোন খোঁজ জানেন না তার বাবা ও মা। এমন কি উত্তম বড়ুয়ার স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে এখন কোথায় আছেন তার তথ্যও দিতে পারেননি কেউ।
উত্তম বড়ুয়ার বাবা সুদত্ত বড়ুয়া জানান, পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অর্থ কষ্টে চরম দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। ছেলের সাথে কোনভাবেই এ পর্যন্ত তাদের কোন যোগাযোগ হয়নি। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছেন উত্তম বেঁচে আছেন।
ঠিক কোন মাধ্যমে উত্তম বেঁচে থাকার তথ্য জেনেছেন তা প্রকাশ করেননি তিনি। তবে সুদত্ত জানান, তার ছেলে দেশে আছে কি বিদেশ আছে তা জানেন না। প্রধানমন্ত্রী চাইলে ছেলেকে তার কাছে ফিরে আনতে পারেন। মৃত্যুর আগে ছেলেকে দেখতে চান তিনি।
উত্তমের মা মাধু বড়ুয়া জানান, ১০ বছর আগে সংঘটিত ঘটনাতে উত্তম কোনভাবেই জড়িত নয়। উত্তমকে ফিরে আনা হলে প্রকৃত সত্য জানা যাবে। তার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার দাবি মায়ের।