১৪ বছরেও ফেরেননি গুম হওয়া মাসুম, বাবাকে এইচএসসির ফল জানানো হলো না মারিয়ার

সুপ্রভাত ডেস্ক »

মারিয়ার বয়স এখন উনিশের কোটায়। অন্য সহপাঠী ও বন্ধুদের মতো তিনিও এবার বাবাকে জানাতে চেয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল। কিন্তু জন্মদাতা মো. মাসুম হোসেনকে দেখেন না ১৪ বছর। গুম হওয়া বাবা কোথায় আছেন, তাও জানা নেই তার। তবু ফেরার অপেক্ষায় চেয়ে আছেন পথ। ছোটবেলা থেকে বাবার খোঁজ চেয়ে রাস্তায়ও দাঁড়িয়েছেন বহুবার। তবে বরাবরই খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। বাবার পুরোনো ছবিই এখন একমাত্র সম্বল।

রাজধানীর পল্লবী সরকারি কলেজ থেকে চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা দেন মারিয়া। ১৬ অক্টোবর প্রকাশিত ফলে তিনিও উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরীক্ষার ফল পেয়ে উল্লাসে মেতেছেন তার সহপাঠীরা। উচ্ছ্বসিত তাদের মা-বাবারাও। কিন্তু মারিয়াকে ফল প্রকাশের ঠিক দুদিন আগেও বাবার সন্ধানে দাঁড়াতে হয়েছিল রাজপথে। সেখানে ছবি হাতে নিয়ে বাবাকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানান সরকারের কাছে।

স্বামীর অবর্তমানে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এখন স্বপ্ন বুনছেন মারিয়ার মা। ভাড়া বাসায় থাকেন মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকায়। মহাখালীর একটি হাসপাতালে আয়া হিসেবে চাকরি করে সংসার চালান তিনি। জোগাচ্ছেন সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও। এর মধ্যেই এইচএসসি পাস করেছেন মেয়ে মারিয়া। তার ধারণা, এ ফল শুনে তার বাবা বেশ খুশি হতেন।

গুমের শিকার মাসুমের পরিবার জানায়, রাজধানীর কাফরুল এলাকায় যুবদলের রাজনীতি করতেন মাসুম। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর হাতিরপুল এলাকায় দুই বন্ধুকে নিয়ে একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে যান তিনি। সেখান থেকে মাসুমকে তুলে নিয়ে যান সাদা পোশাকে আসা কয়েকজন লোক। এরপর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও খোঁজ পাননি স্বজনরা। থানায় জিডি করতে গেলেও নেয়নি পুলিশ। এমনকি প্রায় ১৪ বছর হতে চললেও এখনো কেউ সন্ধান দিতে পারেনি তার। সে কারণে এখনো মাসুমের পথ চেয়ে আছে পরিবার।

আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে গুম-খুনের সঙ্গে জড়িতদের বিচারসহ আট দফা দাবিতে গত ১৪ অক্টোবর মানববন্ধনের আয়োজন করে ‘মায়ের ডাক’। এ মানববন্ধনে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সঙ্গে গুম হওয়া বাবার ছবি বুকে নিয়ে অংশ নেন মাসুমের মেয়ে মারিয়া। তিনিও গুম-খুনে দায়ীদের বিচার দাবি করেন। একইসঙ্গে বাবার সন্ধানও চেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে।

এ নিয়ে কথা হয় মারিয়ার সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা যখন গুম হন তখন আমার বয়স মাত্র ছয় বছর। হাতিরপুল এলাকায় একটি হোটেল থেকে বাবাকে উঠিয়ে নিয়ে যান পাঁচ-সাত জন সাদা পোশাকধারী লোক। আমরা বিভিন্ন জায়গায় তাকে খুঁজতে গিয়েছি। বিভিন্ন হাসপাতাল-মর্গ কোনো কিছুই বাদ রাখা হয়নি কিন্তু কোথাও পাইনি। এভাবেই বাবা ছাড়া ১৪ বছর কেটে গেল।

dhakapost

মারিয়া বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর ভেবেছি বাবাকে ফিরে পাব। অথচ অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর অতিবাহিত হলেও আমরা কোনো খবর পাইনি। আমার বাবার সঙ্গে কী হয়েছিল, তারা কী করেছিল; তাও বলতে পারছি না। কারণ আমাদের এখন পর্যন্ত কোনো খবর দেওয়া হয়নি। সঠিক খবর না দিয়েই আমাদের কেবল ঘোরানো হচ্ছে যে, আমরা তাদের আনব। এ ছাড়া গুমের সঙ্গে জড়িতদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। অথচ এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, গুম হওয়ার ঠিক এক বছর আগে ২০১০ সালে আমার বাবাকে বাসা থেকে নিয়ে যায় র‌্যাব-৪। তখন মাসহ আমরা দুই ভাই-বোন সাভারে থাকতাম। ওই সময় ঢাকায় পরিচিত এক দাদু আমাদের খবর দেন। তখন আমার বাবাকে র‌্যাব-৪ এ রাখা হয়েছিল। এরপর আবার তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১১ সালে তুলে নেওয়ার পর আমরা কোনো দিন ভাবিনি যে বাবাকে আর কখনো পাব না। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া, আমাদের বাবাকে যেন তারা ফিরিয়ে দেয়।

বিভিন্ন হয়রানির কথা তুলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মারিয়া বলেন, আমার বাবা গুম হওয়ার পর আমরা ঢাকায় আসি। এরপর আমাকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। তবে ভর্তির সময় বিভিন্ন কাগজপত্র পূরণ করতে হয়েছিল। এতে বাবা কি করেন, কোথায়, মৃত নাকি বেঁচে আছেন– এসব লিখতে হয়, কিন্তু আমরা সেটা বলতে পারি না। কারণ আমরা তো জানিই না আমার বাবাকে কোথায় নিয়ে গেছে তারা। কোথায় রাখা হয়েছে, আমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে নাকি জীবিত, সেটাই তো জানি না। বাবা না থাকা অবস্থায় এভাবেই আমরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হই।

নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, আমি ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমাদের ফল প্রকাশিত হয়েছে। সহপাঠীরা নিজেদের বাবাকে খবরটি দিতে পারলেও আমি পারিনি। বাবা থাকলে আমিও বলতে পারতাম। ভালো বা খারাপ হলেও বাবার কাছে জিনিসটা ভাগাভাগি করতে পারতাম। অথচ আমার ভাগ্যে সেটা জোটেনি। কারণ বাবা নেই। তবে আমার মা যেহেতু একাই আমাদের জন্য এত বছর কষ্ট করেছেন। তাই আমি ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পাশাপাশি মাকে সহায়তা করতে পারি, চাকরি করার চেষ্টা করব।

মায়ের ডাকের সংগঠক সানজিদা ইসলাম বলেন, বাবা ছাড়াই বড় হয়ে গেল মারিয়া ও তার ভাই। এত বড় একটা বাস্তবতার মুখোমুখি থেকেই বাবার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছে তারা। এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীনও আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে মারিয়া। আসলে তাদের সাহস দেখলে আমরাও বিস্মিত হই। গুম হওয়া বাবাকে ফিরিয়ে আনতে বা জড়িতদের বিচারে দৃঢ় কণ্ঠে দাবি তুলছে তারা। আমাদের এমন বহু পরিবার আছে, যাদের সন্তানদের এখনো অপেক্ষা করতে হচ্ছে বাবাকে ফেরত পাওয়ার জন্য। এর মধ্যে অনেকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে, আবার অনেকে উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। কিন্তু স্বজনের ফেরার অপেক্ষাটা এখনো শেষ হয়নি।

তিনি বলেন, আমাদের চাওয়া হলো গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধান। তারা কি বেঁচে আছেন নাকি মেরে ফেলা হয়েছে তা সঠিকভাবে জানাতে হবে। একইসঙ্গে গুমের সব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করতে হবে।

মায়ের ডাকের সংগঠক বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও আমাদের সঙ্গে আওয়াজ তুলেছে এসব সন্তানরা। তাদের আওয়াজটা বুলন্দ ছিল। সামনেও এত বড় চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার আদায়ে তারা ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছি।