এডভোকেট আহমদ হোসাইন »
শুধু বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালালেই সত্যিকারের আলোক আসে না। তাঁর যুগে তিনি একটি অনগ্রসর সামাজিক অবস্থায় নিজের যোগ্যতাকে উজাড় করে দিয়েছেন। তাঁকে দেখার এবং সান্নিধ্যের সুযোগ আমার হয়েছিল। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত হাসিমাখা অবয়বে কথা বলতেন। তাঁর কথা-বার্তা ছিল একটি খোলা বইয়ের মতো। তিনি বুদ্ধির বেড়াজালে নিজেকে লুকাবার প্রয়াসী কখনো ছিলেন না। এ ধরণের লোক সকলের গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকেন। পরমকাত্রু ও মনে মনে ভালোবাসেন।
তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের তিনটি আমলকে দেখেছেন- বৃটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আমল। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞাতায় সমৃদ্ধ ছিলেন। আমি এক সময়ে সমবায় সমিতির প্রশিক্ষণের বরাবরে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাতদিন ছিলাম। তিনিও ছিলেন। দেখেছি তাঁর মধ্যে একটি শিশু ও কক্কলিয়ে উঠতো, ছিল যৌবনের কর্মচাঞ্চল্য। তিনি অন্ধত্ব: অলসতাকে জয় করেছিলেন। আমাদের গ্রামে-গঞ্জে এ ধরণের অনেকজন আছেন, যাঁরা কখনো প্রচারের উপায়কে স্বপ্নে ও চিনেননি। কিন্তু তাঁদেরকে আলোচ্যমান করার এ কারণে প্রয়োজন যে, সে সকল বনফুলদের ও স্বাভাবিক সৌন্দর্য ছিল, ছিল প্রকাশের তনময়তা ও বিকাশের সুন্দর আয়োজন।
তাঁর মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাস সকল সময়ে কার্যকরী ছিল। তাঁর মধ্যে এ মানসিক সাহস ছিল যে, সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁর চিন্তাধারা ও কর্মদক্ষতাকে একটি আলোকধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নিজ গ্রাম দলইনগরের পটে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তিনি সামাজিক সংযোগসহ সকল প্রেক্ষিতে বিস্তারিত থেকেছেন। সামাজিক সম্ভ্রববোধ প্রতিষ্ঠার প্রতি তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল। সেই সম্ভ্রমপূর্ণ নীতিজ্ঞানের ওপর জনগণের সামাজিক শৃঙ্খলা, একতা ও বিশ্বাসকে তিনি এগিয়ে যাবার প্রেরণা হিসেবে উপস্থাপিত করার প্রয়াসী ছিলেন। তিনি সফলকাম হয়েছিলেন বলেই মৃত্যুর পরও তাঁকে স্মরণ করার প্রয়োজন থাকছে। কারণ তাঁর জীবনকাল থেকে আমরা সুস্থ সামাজিক জীবনের প্রেক্ষাপট নিতে পারি।
তিনি ছিলেন সাধারণ জনগণের কাছের মানুষ। তাঁর স্বগ্রামের দলইনগর সরকারী প্রাথমিম বিদ্যালয়টি ছিদ্দিক মাস্টারের স্কুল হিসেবে বিশেষ পরিচিতিতে থেকেছে। সর্বশ্রেণীর লোকজনের সাথে তাঁর মেলামেশরা ছিল। ঐ গুনটি সকলের মধ্যে থাকে না। দেখা যায় যে, কৃষকের ছেলে লেখা-পড়া শেখে অন্যের প্রতি ক্রোধ প্রকাশে ‘চাষা’ বলে গালি তথা নিন্দাবাদ করে। তিনি শিক্ষিত ছিলেন। গুরু ট্রেনিংও নিয়েছিলেন। তাঁর মানসিকতা শেকড় বিহীন ছিল না। গ্রামীণ জীবনধারায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাঁর অপরিহার্য উপস্থিতি ছিল। এ ধরণের লোক বর্তমানে বিরল। ছিদ্দিক আহমদ মাস্টারের প্রতিভা ছিল একজন কুশলী বিচক্ষণ সমাজবিদ হিসেবে সামাজিক অঙ্গনে নিজের জন্য একটা স্থান করে নিয়েছিলেন। তাঁর ভরাট কণ্ঠে দৃঢ় যুক্তিপূর্ণ জ্ঞানগর্ব আত্মপ্রত্যয়ে জোরালো অপূর্ব উচ্চারণ শৈলির জন্য তিনি নিজ গ্রাম দলইনগর গহিরা, চিকদাইর নোয়াজিশপুর হাটহাজারীর ছিপাতলী মেখল ইউনিয়নসহ উত্তর রাউজানের সকলে বয়সের মানুষের কাছে সুখ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর ওজনদার কথা ইতিহাসের অজানা তথ্যগুলো দর্শক স্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। তিনি তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রেফারেন্স টেনে তত্ত্ব তথ্য যুক্তি উদাহরণ দিয়ে কথা বলতেন। সমাজে তিনি দক্ষ সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও পরামর্শক রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি একটি গতিবান কর্মময় জীবন যাপন করে গেছেন। তিনি স্বধর্মনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনরূপ গোঁড়ামী ছিল না। চঁনষরপ ষরভব এ তিনি সর্বাংশে সফল এবং চৎরাধঃব ষরভব এ তো অসফল বলা যাবে না। কায়িক পরিশ্রমের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। বৃহত্তর পরিমন্ডলে তিনি রাজনীতির জনসেবার দিকটিকে সঙ্গ দিয়েছেন। নিজের সাধ্য সাপেক্ষ বিভিন্ন ঠরষষধমব অরফং ঢ়ৎড়মৎধসসব কে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সর্বাংশে তাঁর মধ্যে আমরা নৈর্বক্তিক মননশীলতাকে (পবৎবনৎধষ) পাচ্ছি। তিনি দলইনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক, গহিরা শান্তির দ্বীপ কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি ও ব্যাংক লিঃ এর সাবেক চেয়ারম্যান ও তৎকালীন গহিরা ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ছিদ্দিক আহমদ মাস্টার একজন আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। রাউজানের গহিরা ইউনিয়নের দলইনগর গ্রামে খন্দকার হামিদ আলী মুন্সির বাড়ী মোহাব্বত আলী’র ওরসে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর আর কোনো ভাই-বোন ছিল না। গ্রামের জায়গা-জমির উৎস থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে সংসার চলতো। শিক্ষা জীবন শেষে তিনি শিক্ষকতা জীবন বেছে নিয়েছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার জন্য। প্রতিটি ছাত্রের পারিবারি ও সামাজিক অবস্থান তাঁর জানা ছিল। তিনি শুধু স্কুলের শিক্ষক ছিলেন না, সমাজের একজন অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে সমাজ গ্রহণ করেছে। বিজ্ঞজনেরা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের আসনে স্থান দিতেন। ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর ৩রা রমজান, ইফতারের সময় ছিদ্দিক আহমদ মাস্টার (৯৯) বছর বয়সে অনেকটা সুস্থ অবস্থায় সকল কর্মমায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।