কামরুল হাসান বাদল »
দেখা হলে বলতেন, মঙ্গল, মঙ্গল। ফোনে বলতেন, মঙ্গল, মঙ্গল। গতকাল থেকে এই সম্ভাষণ আর শোনা যাবে না। আর কেউ বলবে না। মঙ্গলের সে সম্ভাষণকারী মঙ্গল-অমঙ্গলের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। যে ঊর্ধ্বলোকে মানুষ মৃত্যুর পরই যেতে পারে শুধু।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক গানের জীবনমুখী ধারার স্রষ্টা সৈয়দ মহিউদ্দিন যিনি মহি আল ভান্ডারী নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি গতকাল মৃত্যুবরণ করেন।
শারীরিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন তিনি; কিন্তু এক আশ্চর্য মানসিক শক্তির জোরে বেঁচেছিলেন এতদিন।
২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর সুপ্রভাত বাংলাদেশ আয়োজিত ‘চট্টগ্রামে গান’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় তাঁকে। এক পর্যায়ে অনুষ্ঠান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় মঞ্চের পাশের সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে যান তিনি। সে দুর্ঘটনায় তাঁর পা ও হাতের হাড় ভেঙে যায়। সুপ্রভাত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁকে সার্জিস্কোপ হাসপাতালে রেখে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করা হয়। তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে এ লেখাটি প্রকাশ করা হলো।
আগেই লিখেছি সৈয়দ মহিউদ্দিন জীবনমুখী আঞ্চলিক গানের স্রষ্টা। তাঁর লেখা আঞ্চলিক গান মানে ভাবরসে, সুরে, নতুনত্বে ও শব্দচয়নে অসাধারণ মুনশিয়ানা। প্রতিটি গান যেন মাটির শেকড় থেকে ওঠে আসা গণমানুষের জীবনছোঁয়া ছোটগল্পের উৎকৃষ্টতম গাঁথুনি। তাই তাঁর গান চিনে নিতে মোটেই কষ্ট হয় না কারো। কারণ তিনি দীর্ঘদিনের ঘোরপাক খাওয়া একঘেঁয়ে, হালকা প্রেমের আঞ্চলিক গানের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর নিজস্ব ঘরানা প্রতিষ্ঠায় দ্রুত সফলতা অর্জন করেছেন। তাই সংগীতবোদ্ধাদের হৃদয়ে তাঁর আসনটি এখন একেবারে পাকাপোক্ত। উল্লেখ্য, রাগপ্রধান, আধুনিক, মাইজভান্ডারী, অধ্যাত্মিক ও লোকজ নানা শাখায় গান রচনা ও সুরেও তাঁর সুখ্যাতি বিপুল। তিনি শ্যাম-শেফালীর বহু জনপ্রিয় একক ও দ্বৈতগানের সফল গীতিকার ও সুরকার।
মহিভাইয়ের সাথে পরিচয় কবে থেকে তা অনেক ভেবেও স্থির করতে পারলাম না। কিছু-কিছু সম্পর্কের ক্ষেত্রে বোধ হয় এমনই হয়। এই যে সম্পর্কের কথা বললাম, সে সম্পর্কটিই বা কী? তারও কোনো ব্যাখ্যা আছে? চিন্তার ঐক্যের কারণে হোক কিংবা পছন্দের কারণে হোক তা-ও ব্যাখ্যাতীত হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা যারা শহরে মধ্যবিত্ত সমাজে তথাকথিত ভদ্রলোকের জীবনযাপন করি সেখানে সৈয়দ মহিউদ্দিনরা খুব বেশি পরিচিত নন। আলোচিত কিংবা আলোকিত তো ননই। এমন কোনো ব্যক্তির সাথে ঘটনা পরম্পরায় পরিচিত হলে এবং তৃতীয় কারো দ্বারা প্রকৃত পরিচয় পেলে শুধুমাত্র বলে উঠি, ‘ওহ তাই!’
আমরা তো ধরেই নিয়েছি আমাদের ভাবনা-চিন্তা, জানা-শোনা ও পর্যবেক্ষণের ওপরে কিছু নেই। আমরা মেতে থাকি রবির গানে। সুমনের গানে জীবনের চিত্র খুঁজে নিই। জীবনানন্দকে ছাপিয়ে কবিতার উদাহরণ টানতে পারি না। আরেকটু সাম্প্রতিক দেখাতে গিয়ে বলি জয়ের কথা, কেউ কেউ আরও নতুন শ্রীজাতের কথা। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ফাঁকে কখনো-কখনো আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক পর্যন্ত চালিয়ে যাই। মার্কস, কান্ট, রিনি, নিৎসে, সার্ত্রে, ভলতেয়ার, আলবার্ট কামু, দেরিদা, নোয়াম চমস্কি, আবু সয়ীদ আইয়ুব নিয়ে মেতে থাকি। কথায় কথায় তাঁদের উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেদের জ্ঞান-গরিমা জাহির করি আর যেকোনো ঘটনাকে ‘ডিসকোর্স’ করি, তখন আমাদের পাশের হতচ্ছাড়া চেহারার অনাধুনিক পোশাকের সৈয়দ মহিউদ্দিনের দিকে খুব কমই দৃকপাত করি।
আমাদের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিলে কখনো আমন্ত্রিত হন না মহিউদ্দিনরা। এই অনুষ্ঠানগুলো ভরপুর থাকে অন্তসারশূন্য নাগরিক মননে, গরিবের নামে আনা ভিক্ষা বেচে আয়েশি জীবনযাপনকারী বেসরকারি সংস্থার ধূর্ত ব্যক্তিদের দ্বারা। আমাদের নাগরিক উৎসবসমূহে যেখানে প্রায়শই বাইরের ফকির এনে রাজার সম্মান দিই, সেখানে অধুনা অবশ্য মহিউদ্দিনদের ডাক পড়ছে। একটি ক্রেস্ট দিয়ে এখন দেখিয়ে দিই ‘কী মূল্যায়নই না করলাম, বাবা’!
একটি মেকি জীবনযাপন করছি আমরা। বানানো। বাইরে ভদ্রতার, মানবতার, অসাম্প্রদায়িকতার একটি মুখোশ পরে আছি। তা এতই ঠুনকো যে সামান্য আঘাতেও তা কেমন কদর্যভাবে খসে পড়ে। দু-চারখানা বই-টই পড়ে, একটু সম্মানজনক (?) পেশায় থেকে কিছু-কিছু খ্যাতির কথাবার্তা বলতে হয় বলে বলি, কিন্তু মননে, চিন্তায় ও নিজের ভুবনে একেবারে উল্টো মানুষ। অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষ। যা বলি, তা বিশ্বাস করি না, যা বিশ্বাস করি, সে মতে চলি না।
এই ভ-ামিপূর্ণ সমাজে যেদিন মহিভাইকে দেখি এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলি, তাঁর দর্শন, বিশ্বাস, গান ও ভাবনা সম্পর্কে জানি, সেদিন আমার মনে হয়েছিল এক প্রকৃত মানুষের সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি। যার কোনো মুখোশ নেই। অধুনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বইয়ের দোকানে এসে ঢাউস সাইজের কোনো বইয়ের আড়ালে নিজের মুখ লুকিয়ে রাখি পড়ার ছলে, মার্কসীয় দর্শন পড়ে সমাজ বিপ্লবের বড়-বড় বুলি আউড়াই। আর অনেক তত্ত্ব অনুসন্ধান করে যা বলি-লিখি আমি দেখতে পাই লুঙ্গিপরা সৈয়দ মহিউদ্দিন কত আগে, কত অনায়াসে সেসব দর্শন, অনিয়ম, বঞ্চনার কথা তাঁর গানে তুলে ধরেছেন।
এই ধরনের লোকদের সঙ্গে যাঁরা মেলামেশা করেছেন তাঁরা জানেন, এঁরা কতটা সহজ-সরল। তবে সহজ-সরল মানুষের সাথে মেলামেশায় একটা ঝুঁকিও আছে। (ঝুঁকি শব্দটির ব্যবহার ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছি না)। এঁরা অল্পতে তুষ্ট হন। আবার সামান্যতেই অভিমান করেন। একটু ভালোবাসা পেলে মোমের মতো গলে যান। আবার সামান্য অসাবধানতায় এতটা অভিমানী হয়ে ওঠেন যে, তা সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়।
সৈয়দ মহিউদ্দিনের প্রতি আমার ব্যক্তিগত একটা ‘দায়বদ্ধতা’ আছে। কয়েক বছর আগে আমাদের পত্রিকা সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে তাঁকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম ডিসি হিল নজরুল মঞ্চে। সে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময় তিনি আহত হয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি সামান্য সুস্থ হয়ে উঠেছেন এখন। শারীরিকভাবে তিনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছি এত কষ্ট এত টানাটানির মধ্যেও তিনি কখনো মুখটি ম্লান করেননি। আমার প্রতি বা আমাদের পত্রিকার কারো প্রতি সামান্য বিরাগ দেখাননি। দুর্ঘটনাটিকে তিনি তাঁর নিয়তি বলে হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন।
আমি মহিভাইয়ের একজন ভক্ত। সব সময় ভাবি, তাঁর জন্য আমার অনেক কিছু করা দরকার। কিন্তু আমার সামর্থ্য অত্যন্ত কম। ফলে অপার ভালোবাসা ছাড়া দিতে পারি না কিছুই।
সৈয়দ মহিউদ্দিন একজন অসাম্প্রদায়িক, উদার ও মুক্তমনের মানুষ। মানুষকে ভালোবাসাই হলো তার অন্যতম দর্শন। তাই তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে নিয়ে তিনি প্রচুর গান লিখেছেন, গানে সুর দিয়েছেন। দেশে যখন জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছিল সে সময়েও তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গিবিরোধী গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন।
দুঃখ থেকে গেল সে আওয়ামী লীগ সরকার কত আওয়ামী লীগবিরোধীকে পদক, পদবী, সম্মাননা, অর্থ সাহায্য দিয়ে গেল কিন্তু নির্ভেজাল মানুষ, প্রকৃত শিল্পী সৈয়দ মহিউদ্দিনের জন্য কিছুই করল না।