সুপ্রিয় দেবরায়
কনেবিদায়ের সময় অনিলবাবুর পাঞ্জাবি রাত্রির চোখের জলে ভিজে একশা। অল্পবয়সে মা-হারা মেয়েটা তখন থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে।
বাপি, আমি থাকব কী করে তোমাকে ছাড়া!
অনিলবাবু ক্রন্দনরতা মেয়ের পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, এই বোকা মেয়ে, আমি তো মাঝেমাঝেই তোর সাথে দেখা করতে যাবো। আর তুই তো একজন নতুন বাবা পাবি।’
মেয়ে রাত্রি অশ্রুভরা চোখ বাপির পাঞ্জাবিতে ঘষতে ঘষতে বলে, ‘কিন্তু নতুন বাবা কি তোমার মতন হবে?’
অনিলবাবু আশ্বস্ত করেন মেয়েকে, ‘আমার চেয়েও অনেক ভালো হবে দেখিস।’
২
রাত্রির স্বামী দীপঙ্কর একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে মার্কেটিংয়ে কাজ করে। বেশির ভাগ সময়েই কলকাতার বাইরে যেতে হয়। এই তো বৌভাতের তিনদিনের মাথায় চলে গেল ভুবনেশ্বর, কটক। এক সপ্তাহ পরে ফিরল। গত ছয়মাস ধরে একটি কথাই বলে যাচ্ছে, এই টুরের পরেই হানিমুনের প¬্যানটা করে ফেলবে। এবার রাত্রি জানিয়ে দিয়েছে, তোমাকে কোনো হানিমুনের প¬্যান করতে হবে না। তোমার নেক্সট টুরে আমিও তোমার সাথে যাবো, সেটাই আমাদের হানিমুন হবে। তা না হলে আমি নিশ্চিত, আমাদের হানিমুন আমাদের বাচ্চাদের সাথেই করতে হবে।
রাত্রি অবশ্য একটি বাচ্চাদের স্কুলে পড়ায়। সকাল ৯টা থেকে ১২টা। দীপঙ্কর কলকাতাতে থাকলে, ও বেরিয়ে যাওয়ার পরেই রাত্রিও বেরিয়ে যায়। স্কুলটা কাছেই। হেঁটেই যাওয়া-আসা করে। তবে শ্বশুরমশাই প্রায় দিনই রাত্রির সাথে স্কুল পর্যন্ত যান, তারপর ওখান থেকে বাজারের দিকে। শ্বশুরমশাই বিমলবাবুকে রাত্রি ‘নতুন বাবা’ বলেই ডাকে। বাপি ঠিকই বলেছিল, নতুন বাবা খুব ভালো মানুষ। দীপঙ্কর যখন অফিসের কাজে বাইরে যায়, উনি রাত্রিকে নিয়ে সন্ধেবেলায় ঘুরতে বেরন। রাত্রিকে খুশি করার জন্য রাত্রির সাথে ফুচকা খান, শালপাতায় ঘুগনি’র চাট খান আইসক্রিম খাওয়ার কাঠের চামচ দিয়ে। উনি অবশ্য একটা-দুটোই ফুচকা খান, কিন্তু রাত্রিকে কম করে দশটা ফুচকা না খাইয়ে রেহাই দেন না। রাত্রিবেলায় বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন বই থেকে অংশবিশেষ পড়ে শোনান। ওনার প্রিয় তিনজন ঔপন্যাসিক। উনি বলেন, বিংশ শতাব্দীর সেরা বন্দ্যোপাধ্যায়ত্রয়ী। উনি নাকি ছোটবেলায় পনেরো বছর বয়সে পথের পাঁচালী পড়ে এত কেঁদেছিলেন যে সংকল্প করেছিলেন, ভবিষ্যতে পথের পাঁচালী দ্বিতীয়বার আর পড়বেন না। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাটিও দেখেননি। বড় নির্মমভাবেই বিভূতিবাবু সর্বজয়ার হাতে দুর্গাকে মার খাইয়েছেন, মেয়েটির রেললাইন-রেলগাড়ি দেখার প্রত্যাশা অপূর্ণ রেখেছেন, আর শেষে এত অল্পবয়সে এত নির্মমভাবে উনি মারতে পারলেন দুর্গাকে? উনি যখন ওনার মনের এই কথাগুলো রাত্রিকে শোনান, রাত্রির ওর নতুন বাবাকে বুঝতে আর বাকি কিছু থাকে না। বুঝতে পারে এই নতুন বাবার বুকে মাথা রেখে সে নিশ্চিন্তে চিরটাকাল শুয়ে থাকতে পারবে।
শাশুড়ি মা নিভারণী দেবী প্রচ- ব্যস্ত মানুষ। রাশভারী, একটু গম্ভীর। ভালো, তবে আপাদৃষ্টিতে রাত্রির কাছে ঠিক নতুন বাবার মতন মনে হয় না। ভয় না পেলেও রাত্রি সমীহ করে শাশুড়ি মাকে। একবার আড়াল থেকে শুনতে পেয়েছিল নতুন বাবাকে বলতে, লোকে নাতি-নাতনির সাথে যে ঢঙে কথা বলে, তোমাকে লক্ষ করেছি তেমন করে কথা বলতে বউমার সঙ্গে। খেয়াল রেখো, ছেলের বউকে আদর দিয়ে আবার মাথায় তুলো না।
রাত্রি অবশ্য এতে কিছু মনে করেনি। মা এতদিন ধরে স্কুলে পড়াচ্ছেন, একটু মাস্টারনী ভাব তো আসবেই।
শাশুড়ি মা কাকভোরে বিছানা ছেড়ে, স্নান সেরে, ঠাকুরপুজো দিয়ে হেঁসেলে ঢোকেন। তখন পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, সব ঘুমিয়ে। সকাল পৌনে সাতটায় বেরন। একটি স্কুলে গত কুড়িবছর ধরে ইতিহাস পড়ান। স্কুলে যাওয়ার আগে সবার জন্য জলখাবার, দীপঙ্করের জন্য টিফিনবাক্স গুছিয়ে রাখেন। দুপুরের জন্য ডাল-ভাজা-মাছ-তরকারি রান্না করে টেবিলের ওপর ঢাকা দিয়ে রাখেন। রাত্রি সকালে ওঠে শুধু সবার জন্য চা বানায়। আগে শাশুড়ি মা নিজেই বানাতেন। এখন রাত্রি এই সংসারে আসার পর সকালের চা-টা নিজেই বানায়। শ্বশুরমশাই পছন্দ করেন রাত্রির বানানো চা। অল্প দুধ দিয়ে পাতলা করে দার্জিলিং-এর মকাইবাড়ির সুগন্ধওলা চা বানায়। জল ফুটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভিজতে দেয় চা-পাতাগুলোকে। দুধ আলাদা গরম করে পরে মেশায়। রাত্রি চা বানানোর এই প্রণালি বাপির থেকে শিখেছে। বাপি খুব শৌখিন চায়ের ব্যাপারে। শাশুড়ি মা জলখাবার আর চা খেতে খেতেই রাত্রিকে সব বুঝিয়ে দিয়ে তারপর স্কুলের জন্য বেরন। এর মধ্যেই কাজের মাসি চলে আসে। রান্না করা খাবারগুলো ঠান্ডা করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতে বলেন। দুপুর সাড়ে বারোটায় ওনার স্কুল ছুটি। রাত্রি এই সংসারে আসার পূর্বে, উনি স্কুল থেকে ফিরে ভাত করে শ্বশুরমশাইকে খেতে দিতেন। এখন রাত্রি স্কুল থেকে শাশুড়িমায়ের আগে চলে আসে। তাই ভাতটা রাত্রিই করে ফেলে। কিন্তু শাশুড়ি মা কিছুতেই আগে খেতে বসেন না। পরিপাটি করে থালায় ভাত বেড়ে, বাটিতে বাটিতে ডাল-তরকারি-মাছ দিয়ে রাত্রি আর শ্বশুরমশাইকে খেতে দেন। সবার খাওয়া হয়ে গেলে, নিজে কিন্তু অবশিষ্ট ভাঙা মাছের টুকরোটি দিয়ে কাঁধা উঁচু মাছের ঝোলের থালাটিতেই ভাত নিয়ে খেতে বসেন। ঐ থালাতেই একপাশে তরকারি-ভাজা নিয়ে নেন। ডালের বাটি থেকে বাকি ডালটি প্রয়োজন হলে ঢেলে নেন। রাত্রি অনেক দিন বলেছে, তুমি এমন করে কেন খাচ্ছ মা? তুমি টেবিলে বসে খাও, আমি আলাদা থালাতে গুছিয়ে দিচ্ছি।
কিন্তু উনি শোনেন না। ওনার নাকি এটাই অভ্যাস হয়ে গেছে, এইভাবেই ওনার খেতে ভালো লাগে। খেতে খেতেই গল্প করেন, বিয়ে হয়ে আসার পর দেখেছেন সবাইকে একসাথে থাকতে। গ্রামের বাড়িতে শ্বশুরমশাই, শাশুড়ি মা, দুই ভাসুর, দুই জা, দুই ভাসুরের চারটি ছেলেমেয়ে এবং নিজের দীপঙ্করটিকে নিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। গ্রামে জমিজমা, কাপড়ের দোকান নিয়ে সুখী সংসার। নিজের স্বামী করতেন শিক্ষকতা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। দুইবেলা সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে, খাইয়ে তারপর তিন বউ আর শাশুড়িমা বসতেন খেতে। যা অবশিষ্ট থাকত তাই দিয়ে। একেক বউয়ের ভাগ্যে হয়তো জুটত ভাঙা মাছের একটা টুকরো অথবা এক টুকরো মাংস, একচামচ ডাল। যতই পরিমাণে রাঁধা হোক, কম পড়েই যেত তিন বউয়ের ভাগ্যে। এইভাবেই বিয়ের পর থেকে খেতে উনি অভ্যস্ত। রাত্রিকে বলতেন, এই নিয়মটা নাকি ওনার শাশুড়ি মা জীবিত থাকাকালীন শুরু করিয়েছিলেন বউমাদের দিয়ে।
কিছুদিন পর নিভারণী দেবীর স্বামী কলকাতাতে ব্যাংকে চাকরি পেয়ে চলে আসেন। ছেলে দীপঙ্কর তখন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। সেই সুযোগে শহরে আসার পর নিভারণী দেবী বি-এডটা পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ফেলেন। শিক্ষকতার জীবন শুরু হয়ে যায়। ওনার স্বামী বিমলবাবুর সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা না থাকলে অবশ্য এটা সম্ভব ছিল না। রাত্রি বিয়ের সময় দুই জেঠু, জেঠিমা, জেঠুদের তিন ছেলে এবং তাদের স্ত্রীকে দেখেছে। বড় জেঠুর মেয়ে লন্ডনে ডাক্তার স্বামীর সাথে থাকে, আসতে পারেনি। নতুন বাবা বলেছেন, সামনের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। গ্রামে অবশ্য এখন জেঠু আর জেঠিমারাই থাকেন। ছেলেরা কেউ মুম্বাই, কেউ বেঙ্গালুরু।
রাত্রির খুব মন খারাপ হয়ে যায় শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে। ওনার বিয়ের পর থেকেই সবার খাওয়া হয়ে গেলে তবেই খেতে বসেন। কিন্তু অনেকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও শাশুড়ি মাকে রাত্রি রাজি করাতে পারেনি এক সাথে বসে খাওয়ার জন্য। আবার রাত্রির মনে একটা খটকাও লাগত, শাশুড়ি মা এই ধনুকভাঙা পণ কেন নিয়েছেন! কী রহস্য আছে এর পিছনে ? আগে গ্রামের বাড়িতে এই নিয়মকানুন ছিল। কিন্তু এখন তো সবাই এক সাথে টেবিলে বসে খায়। সেটাতেই সবার আনন্দ। রাত্রি তখন নতুন বাবার দ্বারস্থ হয়। নতুন বাবা জানান, হয়তো ওনার মনের গহীনে কোনো সুপ্ত অভিমান আছে। হতে পারে সেটা নতুন বাবার ওপর। কারণ বিমলবাবু যে সেরকমভাবে কোনওদিন একসাথে খাওয়ার জন্য জোর করেননি নিভারণী দেবীকে। ছেলেও বোধ হয় বলেনি।
৩
আজ রোববার। ছুটির দিন। দীপঙ্করও বাড়িতেই আছে আজ। গতকাল নতুন বাবাকে দিয়ে রাত্রি মাংস, ভেটকি মাছ আনিয়ে রেখেছে। খুব ভোর ভোর থাকতেই রাত্রি ওঠে পড়েছে আজ। গতকালই কাজের মাসিকে দিয়ে ফুলকপি, আলু, পেঁয়াজ কাটিয়ে রেখেছিল। নিজেকে পরিষ্কার করে যখন রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে, দেখে শাশুড়ি মা ওঠে পড়েছেন। এতদিনের অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে নিভারণী দেবী যেই রান্নাঘরে ঢুকতে গেছেন, রাত্রি এসে বাঁধা দেয়।
আজকে মা তুমি রান্নাঘরে একদম ঢুকবে না। নতুন বাবার সাথে গল্প করো, বই পড়ো, যা খুশি তাই করো, কিন্তু রান্নাঘরে একদম পা দেবে না।
অগত্যা নিভারণী দেবী একটু বিষাদ মনেই নিজের ঘরের দিকেই পা বাড়ান। বউমার সাথে তর্কাতর্কিতে যান না। এটা ওনার স্বভাববিরুদ্ধ। মনে মনে অবশ্য এও ভাবেন, বউমার একটু শখ হয়েছে রান্না করার। করুক। একটু পরেই গরমের তাতে এসে বলবে, মা বাকিটা তুমি করো।
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে রাত্রি সুন্দর করে কাচের প্লেটে, ছোট ছোট করে কাটা আলু আর ফুলকপির তরকারি কালো জিরে দিয়ে বানানো আর মুচমুচে গরম গরম পরোটা পরিবেশন করে। তারপর চা। সবাই হাসিমুখে তৃপ্তি করে খেয়ে রাত্রির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। নিভারণী দেবী বলেন, বৌমা, খুব ভালো খেলাম। এবার তুমি আরাম করো। মুখচোখ আগুনের তাপে, গরমে একদম লাল হয়ে গেছে। তোমার অভ্যাস আছে নাকি! এবার আমি রান্নাঘরে ঢুকি।
রাত্রি চোখ পাকিয়ে বলে, একদম নয়, মা। সকালেই কথা হয়ে গিয়েছে আমার আর তোমার মধ্যে। আজ তোমার রান্নাঘর থেকে একদম ছুটি।
নিভারণী দেবীর সময় আর কাটতে চায় না। গল্পের বইতেও মন বসাতে পারছেন না। বারবার রান্নাঘর পর্যন্ত গিয়ে আবার গুটিগুটি পায়ে বৌমার ধমকের ভয়ে নিজের ঘরে ফেরত চলে আসছেন। গন্ধটা কিন্তু ভালোই বেরিয়েছে। বৌমা রান্নাটা ভালোই করে বুঝতে পারছেন।
দুপুর একটায় রাত্রি সবাইকে খেতে ডাকে। ডাইনিং টেবিলে তিনটি থালায় কাজু, কিশমিশ, এলাচ দিয়ে বানানো মিষ্টি পোলাও, পাশে লম্বা লম্বা বেগুনভাজা, একটি বাটিতে মাখামাখা মাংস, আর একটি বাটিতে সর্ষে-কাঁচালঙ্কা চিরে ভেটকি মাছের ঝাল।
তিনটে থালা কেন? আমরা তো চারজন বৌমা।
নিভারণী দেবীর প্রশ্নে রাত্রির জবাব, আজ তোমাদের সবাইকে পরিবেশন করে খাইয়ে, তারপর আমি খাব। কাজের মাসিকেও বলেছি আজ এখানে খেয়ে নিতে। ও অনেক সাহায্য করেছে আজ।
নিভারণী দেবীর অজান্তেই ওনার চোখ দুটো অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে আসে। চেয়ারে বসেই বৌমার কোমর জড়িয়ে বলেন,
কতদিন পর আমার হারিয়ে যাওয়া মাকে আজ ফেরত পেলাম। বৌমা। বিয়ের আগে মা থালায় এ রকম খাবার সব গুছিয়ে দিয়ে পাশে বসে খাওয়াত।
আমিও যে আমার ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া মাকে এখানে এসেই পেয়েছি।
বিমলবাবু বলে ওঠেন, বুঝলে বউমা, তুমি আজকে বোধ হয় এই সংসারের মধ্যে যে একটা গুমোট আবহাওয়া সবার অজান্তে বইছিল সেটাকে দূর করে দিলে। ছোটবেলায় বাবা বলতেন, সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু …