দখল ও দূষণ
নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
কক্সবাজার সদর মডেল থানা থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উত্তরে বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট এলাকা। নদীর অপরপাশে খুরুশকুল। মাঝখানে বাঁকখালী নদীর ওপর তৈরি হচ্ছে ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে সেতু। সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই শুরু হয়েছে নদী ও তীরের প্যারাবন দখল।
অভিযোগ রয়েছে, প্রথমে দস্যুরা প্যারাবনের গাছপালা নিধন করে পরে বালু ফেলে নদী ভরাট করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করে। এভাবে সংযোগ সড়কের পাশে ৬শ’ হেক্টরের অধিক এলাকার প্যারাবন উজাড় করে তৈরি হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা।
বনবিভাগের তথ্যমতে, ওই এলাকায় বাঁকখালী নদী এবং তীরে ৬শ’ হেক্টর প্যারাবন রয়েছে। এ প্যারাবন ২০৫ প্রজাতির আবাসস্থল। এছাড়া অন্যান্য জীব বৈচিত্র্য তো রয়েছেই। কিন্তু এ প্যারাবনের গাছপালা উজাড় হওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। জলাভূমি ভরাটের কারণে সংকুচিত হয়ে পড়েছে নদীর গতিপথ। পরিবেশবাদীদের অভিযোগ এসব বন্ধে তৎপর নয় জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর।
সরেজমিন দেখা গেছে, কস্তুরাঘাট থেকে সেতুতে যাওয়ার সংযোগ সড়কের উত্তর পাশ সংলগ্ন প্যারাবনের বিশাল এলাকা টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে স্থানীয় দখলবাজ একটি চক্র। এক সপ্তাহ আগেও এখানে এই বেড়া ছিল না। স্থানীয় কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, ২৫ মার্চ রাতে ৩০-৪০ জন লোক এসে টিনের বেড়া দিয়ে প্যারাবনের বিশাল এলাকা ঘিরে ফেলেন। কেউ বাধাও দেন নি। ঘিরে রাখা স্থানের বন ধ্বংস করে তৈরি হয়েছে অসংখ্য টিনের ঘর। বালু দিয়ে নদীর জমি ও ভরাট করা হচ্ছে। উত্তরদিকের কস্তুরাঘাট এলাকায় সড়কের দুই পাশের প্যারাবন দখল করে তৈরি হয়েছে ৪০টির বেশি ঘরবাড়ি। এসব ঘরে পাহারায় রাখা হয়েছে মজুর শ্রেণির কিছু মানুষকে। ঘরবাড়ির পেছনে থাকা প্যারাবনের বিশাল এলাকা টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এভাবে প্যারাবনের অন্তত ১৫টি স্থান ঘিরে রাখার দৃশ্য চোখে পড়েছে।
ঘরটির পেছনে টিনের বেড়ার মধ্যে থাকা কেওড়া গাছগুলো রাতের আঁধারে কেটে ফেলা হচ্ছে জানিয়ে লোকমান হাকিম নামের এক পাহারাদার বলেন, প্যারাবনের গাছপালা নিধনের পর বালু ফেলে জলাভূমি ভরাট করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি প্লটের দাম ১০-১৫ লাখ টাকা। শুধু প্যারাবন দখল ও নিধন নয়, কক্সবাজারের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীতে সমান তালে চলছে অবৈধ দখল ও দূষণের কাজও। নদীটি ভরাট এবং অবৈধ দখলের কারণে এখন অস্থিত্ব সংকটে পড়েছে। দূষিত হয়ে গেছে পানিও। বাঁকখালী নদীর দৈর্ঘ্য ৯০ কিলোমিটার হলেও দখল ও ভরাট চলছে মাত্র ২৫ কিলোমিটার এলাকায়। বাঁকখালী নদীটি বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এবং হাইকোর্টের নির্দেশে নদীর দু’তীরে অবৈধ দখলদারের একটি তালিকা তৈরি করেছে জেলাপ্রশাসন। তালিকায় ৯২ দখলদারের নাম উঠে আসলেও অধিকাংশ প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারের নাম বাদ পড়েছে বলে পরিবেশবাদীদের অভিযোগ।
জানা গেছে, বাঁকখালী হচ্ছে কক্সবাজার জেলার প্রধান নদী। বলতে গেলে কক্সবাজার শহরের প্রাণ। এ নদীর উপর অন্তত ৭ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। এছাড়া বিভিন্নভাবে আরো কয়েক লাখ মানুষ নির্ভরশীল। তাই সাধারণ জনগণের স্বার্থে যে কোনভাবে এ নদীটি রক্ষা করা প্রয়োজন। অথচ জনগুরুত্বপূর্ণ এ নদীটি অবৈধভাবে দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলছে প্রভাবশালীরা। আবার অনেকেই নদী ভরাট করে আবাসনপ্লট তৈরি করে বিক্রিও করছে।
সরেজমিন পরিদর্শনে স্থানীয়রা জানান, আগের মতোই বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট ও বিআইডাব্লিউটিএ ঘাটের উত্তরপাশে অনায়াসে বর্জ্য ফেলছে পৌরসভা। গাড়িতে করে এনে টনটন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। বর্জ্য ভরে ফেলা হচ্ছে উপকূলীয় বনবিভাগের সৃজিত বিস্তীর্ণ প্যারাবনেও। বর্জ্যরে দুর্গন্ধে আশেপাশের পরিবেশ দূষিত হয়ে যাচ্ছে। এসময় বর্জ্য ফেলার কাজে নিয়োজিত পৌরসভার কর্মচারী শ্রমিকেরা জানান, নিষেধের কথা তারা জানেন না।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার পৌরসভার প্যানেল মেয়র শাহেনা আকতার পাখি বলেন, শহরের বর্জ্য ডাম্পিংয়ের জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা মিঠাছড়িতে ডাম্পিং স্টেশন করা হয়েছে। বর্জ্য ওখানেই ফেলা হচ্ছে। তবে শ্রমিকরা মাঝে-মধ্যে বাঁকখালী নদীতেও ফেলছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিট মামলার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হায়দার হোসেন ও ভবানীপ্রসাদ সিংহ এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বাঁকখালী নদী দখলদারদের তালিকা তৈরি করে তাদের উচ্ছেদ ও দূষণের উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি যে কোন উদ্দেশ্যে নদী ইজারা থেকে বিরত থাকতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ১০ সরকারি কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। আদালত বাঁকখালী নদীকে কেন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করতে নির্দেশ প্রদান করা হবে না বা কেন প্রাথমিক প্রবাহ ও সিএস জরিপ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ পূর্বক তা রক্ষা করার নির্দেশ প্রদান করা হবে না, কেন নদীর উভয় তীরের উপকূলীয় বন ফিরিয়ে আনার নির্দেশ প্রদান করা হবে না তা জানতে রুল জারি করে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, ‘বাঁকখালী নদীর প্যারাবন দখল ও ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুইটি মামলা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। তবুও প্যারাবন দখল ও দূষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। নিয়মিত অভিযান চালানোর মতো পর্যাপ্ত লোকবল নেই আমাদের।’
কক্সবাজারে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের বেশ ক’জন পরিবেশবাদী বলেন, গত দুইমাসে সংযোগ সড়কের পাশের প্যারাবনের প্রায় ৬শ’ হেক্টর এলাকার ৪০ হাজার কেওড়া ও বাইনগাছ কেটে শতাধিক টিনের ঘর তৈরি হয়েছে। গাছপালা উজাড় হওয়ায় ২০৫ প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়া নদীর অন্যান্য এলাকায়ও দখল ও ভরাটের কারণে নদীর গতিপথ সংকোচিত হয়ে পড়েছে। এসব বন্ধে জেলা প্রশাসন তৎপর না থাকার সুযোগে উজাড় করা প্যারাবনের জমিতে প্লট বানিয়ে দখলদারেরা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট দিয়ে এক সময় চট্টগ্রামের সঙ্গে জাহাজ চলাচল ছিল। পৌরসভার প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল কস্তুরাঘাট। এখান থেকে খুরুশকুল পর্যন্ত নদীর প্রস্থ ছিল দেড় কিলোমিটার। এই দেড় কিলোমিটার জুড়েই পানির প্রবাহ ছিল। দখল, দূষণ এবং ভরাটের কারণে এখন নদীতে পানির প্রবাহ আছে কোথাও ৪০০ মিটার, কোথাও ২০০ মিটার। ৫৯৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে সংযোগ সেতুর কাজ শুরুর পর থেকে নদীর বুকে সৃষ্ট প্যারাবন ও জলাভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে।
এক দশক আগে জাপানি একটি সংস্থার সহযোগিতায় পরিবেশ অধিদপ্তর এ প্যারাবন (ম্যানগ্রোভ) গড়ে তুলেছিল। গাছগুলো এখন ২০-৩০ ফুট উঁচু হয়েছে। এসব কেওড়া ও বাইনগাছ ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলকে রক্ষা করত জানিয়ে পরিবেশ কর্মীরা বলেন, প্যারাবনের গাছ কেটে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। গাছের গোড়া যেন দেখা না যায়, সে জন্য পাহাড় কাটার মাটি এবং ড্রেজার মেশিনে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে ফেলা হচ্ছে প্যারাবনের বিরান ভূমিতে।
এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ বলেন, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে হাইকোর্টেও নির্দেশনা আছে। ইতোমধ্যে কয়েক দফা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু কতিপয় দখলদার প্যারাবনের বিপরীতে কাগজ প্রদর্শন এবং উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসায় অভিযান পরিচালনায় সমস্যা হচ্ছে।