রতন কুমার তুরী »
সুকুমার রায়ের সাহিত্যের সাথে বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষ কমবেশি পরিচিত। ছোট-ছোট কথাকে শিশুদের বোধগম্য ভাষায়ং সাহিত্যে রূপান্তর করার অসামান্য দক্ষতা ছিল তাঁর। খুব সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এত অল্প বয়সে আর কোনো সাহিত্যিক এত ক্ষুরধার মেধার স্বাক্ষর রেখে মৃত্যুবরণ করেননি। বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত মেধাবী এই সাহিত্যিক মাত্র ৩৬ বছর বেঁচেছিলেন। ওই বয়সেই তিনি বাংলা শিশু সাহিত্যে এমন অবিস্মরণীয় অবদান সৃষ্টি করেন যে, তাঁর স্বাদ চিরন তুন বলে অনুভব করি। প্রথম কবিতা ‘মুকুল’ পত্রিকায় প্রকাশ মাত্র ন’বছর বয়সে নাম ‘নদী’। তারপর ১৩১৩-তে প্রথম গদ্য ‘মুকুল’-এই, নাম ‘সূর্যের রাজা’। প্রবাসীতে ১৩১৭ সালে প্রবন্ধ ‘ভারতীয় চিত্রশিল্প’। ১৯০৮-০৯ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ননসেন্স ক্লাবে’র জন্য নাটক রচনা করলেন ‘ঝালাপালা’ ও লক্ষ্মণের শক্তিশেল’। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ১৯০২ সালে। এ সময়ে তিনি ব্রাহ্মসমাজের ছাত্রবিষয়ক দপ্তর-এর সঙ্গে যুক্ত হলেন। এখানে তাঁর সঙ্গে অনেক উৎসাহী সমমনোভাবাপন্ন বন্ধুর যোগাযোগ ঘটে। ১৯০৬ সালে তিনি পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্রে অনার্স নিয়ে বিএসসি পাস করলেন। এরপরই তার ‘ননসেন্স ক্লাবে’র কাজকর্ম শুরু হল।
১৯১১ সালে সুকুমার রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ বৃত্তি’ লাভ করে লন্ডনে গেলেন ‘চিত্রমুদ্রণবিদ্যা’ শেখার জন্য। সুকুমারের ফটোগ্রাফ ও অঙ্কনে ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক ছিল। ব্রিটেনের ‘Boys own Paper’ পত্রিকায় ফোটোগ্রাফির এক আন্তজার্তিক প্রতিযোগিতায় তিনি তৃতীয় স্থান লাভ করেন মাত্র সতেরো বছর বয়সে।
সুকুমার রায়ের জীবনে কবিগুরুর প্রভাব অনেকখানি। যখন রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে গেলেন সুকুমার উচ্চশিক্ষার জন্য সেখানে, ত্রা আবাসস্থল থেকে কবির বাসস্থান খুব কাছেই। এখানেই কবির সঙ্গে তার যোগাযোগ ক্রমশ অন্তরঙ্গতায় পরিণত হল। সুকুমার এই যোগাযোগের বিবরণ বিস্তারিত ভাবে ত্রা মা-বাবা ও ঘনিষ্ঠদের চিঠি লিখে নিয়মিতভাবে জানাতেন। প্রায় দিনই কবির বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকত, এবং বলাবাহুল্য সেখানে অনেক বিদ্বান ব্যক্তিদের সঙ্গে চলত সাহিত্যের নানা আড্ডা। তিনি রবীন্দ্রনাথের অনেক গান-কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, যা ইংল্যান্ডের গুণীমহলে সমাদৃত হয়েছিল। সেইসঙ্গে কবিও সন্তোষ লাভ করেছিলেন।
সুকুমার রায় উচ্চশিক্ষা থেকে ফিরে এসে রীতিমত শিশুসাহিত্য রচনার কাজে হাত দিলেন। পিতার মৃত্যুর পর ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সমস্ত ভার ত্রা ীপর এসে পড়ল। পত্রিকার যে মান পিতা সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন, তা বজায় রাখার জন্য সর্বতো প্রচেষ্টা চলল। সত্যিই আমৃত্যু তিনি ‘সন্দেশ’ পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে গিয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র’র মন্তব্য অনুসারে ‘তখনকার কয়েক বছরের ‘সন্দেশ’ পৃথিবীর যে কোনো ভাষার শিশু পত্রিকার সঙ্গে বুঝি পাল্লা দিতে পারত।’
তারপর একে একে যেন দৃশ্যান্তরপর্ব চলতে লাগল ‘গোঁফচুরি, ‘কাঠবুড়ো’, ‘সৎপাত্র’, ‘গানের গুঁতো’, ‘কুমড়ো পটাশ’ নতুন নতুন রসে অসম্ভবকে সবার সামনে ছন্দে ভাষায় ও ছবিতে এনে ফেলা। তাঁর প্রতিটি ছড়ার সঙ্গে তাঁর স্বহস্তে অসাধারণ অঙ্কনচিত্র কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করেছে।
সুকুমার রায়ের নাটকের সংখ্যা আটটি। ননসেন্স ক্লাবের জন্য তিনি নাটক লিখেছেন যা সদস্যরা সকলে মিলে অভিনয় করতেন। ‘ঝালাপালা’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘চলচিত্ত চঞ্চরি’, ‘শব্দকল্পদ্রুম’Ñ এগুলো আকারে বড় নাটক। এছাড়া ছোট আকারের ‘অবাক জলপান’, ‘হিংসুটে’, ‘ভাবুক সভা’, ‘মামা গো’এই চারটি নাটক রয়েছে।
মনে হয় সুকুমারের ছড়া বা নাটক নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছে তার গল্প, প্রবন্ধ নিয়ে ততটা হয় না। অথচ তাঁর রচনার প্রায় সত্তর ভাগের বেশি অংশ রয়েছে গল্প আর প্রবন্ধ নিয়ে। সত্তরটি গল্প, ষোলটি জীবনী ও একশ আটাশটি প্রবন্ধ তিনি রচনা করেন, যার মধ্যে দুটো ইংরেজিতে। এর চেয়েও অনেক বেশি তাঁর রচনাসম্ভার, কারণ তিনি লন্ডনে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা অনুবাদ করেন। অন্তত দুটো প্রবন্ধ তিনি ওখানে পাঠ করেন, যেগুলোর সন্ধান মেলেনি। তাঁর গল্পের মধ্যে বিখ্যাত ‘হ য ব র ল’, ‘পাগলা দাশু’। তাঁর লেখা বিজ্ঞানের গল্প, জীবনী ও প্রবন্ধগুলো যেন তাঁর বিজ্ঞান প্রতিভাকে মনে করিয়ে দেয়। ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ আমাদের এক নতুন অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধান দেয়। পুত্র সত্যজিতের হাতে পড়ে সে যেন সম্পূর্ণ রূপ পায় ‘প্রোফেসর শঙ্কু[তে।
সুকুমার রায় মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে চলে না গেলে নিশ্চিতভাবে তাঁর কাছে বাংলা শিশুসাহিত্য সমৃদ্ধি লাভ করত। জীবদ্দশায় তাঁর কোন গ্রন্থ প্রকাশ হয়নি। মৃত্যুর ন’দিন পর ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৩, তার প্রথম ছড়ার গ্রন্থ ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশিত হয়। তাঁর মৃত্যুর সময় পুত্র সত্যজিৎ রায়ের মাত্র আড়াই বছর বয়স। পরবর্তী জীবনে যিনি পিতার রচনা সম্ভারকে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণকারী অকাল প্রয়াত সুকুমার রায় ১৯২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
প্রকৃতপক্ষে সুকুমার সাহিত্যের বেশির ভাগ শিশুসাহিত্য হলেও এর মধ্যে অনেকগুলোই ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক। ইংরেজিতে ব্যাপকভাবে দক্ষতা অর্জনের কারণে সুকুমার রায় লন্ডনেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। সুকুমার সাহিত্য যুগ যুগ ধরে শিশুদের প্রেরণা জোগাবে।