রায়হান আহমেদ তপাদার »
শিক্ষা একজন মানুষকে শুধু যোগ্য ও বিচার-বিবেচনাশীল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন করে না, তাকে বিনম্র, মার্জিত ও রুচিশীলও করে। শিক্ষার মাধ্যমেই একজন সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠেন। কোনো খুশির ব্যাপারে কিংবা কোনো সাফল্যে একজন অশিক্ষিত-অমার্জিত মানুষ যেভাবে আবেগ ও আনন্দ-উল্লাসের প্রকাশ ঘটাবে, একজন শিক্ষিত মানুষের আনন্দের প্রকাশভঙ্গি হবে অন্য রকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। যেমন; এসব প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত জটিল বিষয়ে শিক্ষককে পাঠদান করতে হয়। এজন্য প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীদের সুনির্দিষ্ট একটি মানের ভিত্তিতে ভর্তি করা হয়। এই পাঠদান অনেকটা ছাত্রছাত্রীদের প্রণোদনা জোগানোর মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে শিক্ষক যা বললেন তাই যথেষ্ট নয়। বরং তিনি আরও যেসব বই বা মুল্যবান তথ্যাদি সংগ্রহ করার কথা বলবেন, সেসবও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই বলা হয় যে সুশিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পঞ্চাশ মিনিট বা এক-দেড় ঘণ্টার একটা ক্লাসে শিক্ষক যা বললেন, তা দিয়েই জ্ঞানচর্চা পূর্ণ হয় না। শিক্ষক ক্লাসে আরও কিছু বই শিক্ষার্থীদের পড়তে বলবেন। সেগুলো অনুধাবন করতে বলবেন। প্রয়োজনবোধে এগুলো নিয়ে পরে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সঙ্গে আরও আলোচনায় বসতে পারে। এভাবেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান এগিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এখানে কেবলই পাঠদান, জ্ঞানচর্চা বা বিদ্যমান জ্ঞানভা-ার থেকে পড়াশোনা হয় তা নয়।
বরং একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই নতুন নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। একটি জাতি বা সমাজের নতুন জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচিত হয় এ ধরনের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় রাখলে বলতে হয়, সমাজ বা জাতির জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনেক বেশি। একটি জাতির যে কোন বিষয়ে জ্ঞানের নতুন জগত এখানে তৈরি হয়। তা সে বিজ্ঞান বিষয়ে হোক কি তথ্যপ্রযুক্তি বা সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়েই হোক। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার একটি পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা নতুন জ্ঞান খুঁজে নিতে চেষ্টা করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ জন্য ব্যাপক তাগিদ তৈরি হয়। এসব কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটা আবহাওয়া দরকার যেখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের নেশায় ছুটতে পারে।
আমাদের দেশের সব নাগরিক সেই পুরনো অথচ সত্য কথাটিই ঘুরেফিরে সচরাচর বলেন, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। অথচ কার্যত এর চর্চা এবং চর্চাক্ষেত্রগুলো অবহেলিত ও উপেক্ষিত। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর শিক্ষার পরিবেশ দিন দিনই দ্রুত খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। যদিও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ই দেশের দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বল্প খরচে জ্ঞানার্জনের প্রধান অবলম্বন। বেশি খরচে যেসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শেখে, তাদের শিক্ষার মান ও শিক্ষার পরিবেশ তেমন উন্নত বলে কেউ ভরসা দিচ্ছে না। এমনও শোনা যায়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই নাকি উচ্চমূল্যে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট বিক্রি করে।
তাই বিত্তবানদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেমেয়েদের ইউরোপ, আমেরিকা বা ভারতের মতো দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান। তাই উচ্চশিক্ষার কথা বিবেচনা করলে আমরা উভয় সংকটে আছি।
না ঘরকা না ঘাটকা। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করলে আমাদের এই দরিদ্র দেশে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই প্রধান অবলম্বন। কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক দলবাজি, হানাহানি, খুনোখুনি এবং সর্বোপরি এ জাতীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা ও অপরিপক্কতা দেশের বিবেকবান ও দায়িত্বশীল নাগরিকদের শুধু যে ভাবায় তাই নয়, আতঙ্কিতও করে। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করলে আমাদের এই দরিদ্র দেশে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই প্রধান অবলম্বন। কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক দলবাজি, হানাহানি, খুনোখুনি এবং সর্বোপরি এ জাতীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা ও অপরিপক্কতা দেশের বিবেকবান ও দায়িত্বশীল নাগরিকদের শুধু যে ভাবায় তাই নয়, আতঙ্কিতও করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক দলবাজি, দায়িত্বে অবহেলা ও নানা ছুতানাতায় অবরোধ-আন্দোলনে শিক্ষকরাও কম যান না। সরকারি কলেজগুলোতেও তাই। এ ব্যাপারে রাজনীতিকরাও দায় এড়াতে পারেন না। কারণ তারা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের রাজনীতিতে উৎসাহিত করেন। অভিযোগ আছে,এ লক্ষ্যে তারা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নানা জাতীয় সুবিধাও দিয়ে থাকেন।
এমনকি রাজনীতিকরা রাজনীতির ঊর্ধে থেকে জাতীয় স্বার্থে দেশ গড়ার যথার্থ কর্মীকে স্বীকৃতি দিতে যত এগিয়ে আসবেন, দেশ তত দ্রুত অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে। রাজনীতি নয়, জাতীয় স্বার্থে কৃত উচ্চমানের কর্মই সাফল্যের মাপকাঠি- এ ধারণা যত বদ্ধমূল হবে, দেশ তত দ্রুত সাফল্যের পথে এগোবে। দেশের জনগণ যাতে কর্মোদ্যোগী হয়ে ওঠে, সে শিক্ষার বিস্তার করা আমাদের জরুরি। যেমনটা যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে হয়েছে। কোরিয়াতে হয়েছে। তারা নতুন নতুন শিল্প গড়ে তুলছে। আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশ ভিয়েতনাম। সবচেয়ে আশ্চর্যের ও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা সেসব দেশে অতি উন্নতমানের অত্যাধুনিক টেকসই দৃষ্টিনন্দন নির্মাণ ও বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করছে। কিন্তু দেশের ভেতরে আমরা তাদের কাজে লাগাতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের ভাবতে হবে। এখানে নোংরা রাজনীতির কিংবা রাজনীতি নিয়ে নোংরামিও দায়ী হতে পারে। তা না হলে আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান খাতগুলো এত পিছিয়ে কেন? স্বাধীনতার ৪৯ বছর কি একটি জাতির জন্য কম সময় ও সুযোগ? যে রাজনীতি নিয়ে আমরা পড়ে আছি, সে বিষয়েও আমাদের শিক্ষা অনেক পশ্চাৎপদ। যদি তাই না হবে তবে বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বারবার নাক গলানোর সুযোগ পায় কী করে? তাদের সুপরামর্শ ছাড়া দেশ অচল! এ হতাশাজনক ও লজ্জাকর পরিস্থিতির কবে অবসান হবে?
এছাড়া দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের অনেকেই বর্ণের আবরণে জাতীয় দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করে ক্যাম্পাসের একাডেমিক পরিবেশ কলুষিত করেন। আর যখন শিক্ষকদের রাজনীতি ছাত্রদের রাজনীতির সঙ্গে মিলেমিশে যায়, তখন আর শিক্ষকতার পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার অহঙ্কার বলে কিছু থাকে না। শিক্ষক ও ছাত্রদের ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি চর্চার সমালোচনা করে বিশেষজ্ঞ মহল বলছেন যেসব শিক্ষক দলীয় রাজনীতিতে জড়িত, তাদেরকে একটু ভেবে দেখতে, সক্রিয় রাজনীতিতে আপনাদের সংশ্লিষ্টতা শিক্ষার উপকারে এসেছে, না তাতে রাজনীতির কোনো উপকার হয়েছে? সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা তাদের একাডেমিক স্বার্থ দেখভালের রাজনীতি করেন না। তারা বর্ণের আবরণে জাতীয় দলীয় রাজনীতির চর্চা করেন। লেখাপড়া ও গবেষণায় মনোযোগী না হয়ে তাদের অনেককে নানা রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের মতো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শ্রেণিকক্ষে; গবেষণা, প্রকাশনা, শিক্ষার মানোন্নয়ন, সেশনজট নিরসন এবং গ্র্যাজুয়েটদের মানোন্নয়নে। কাজেই শিক্ষকদের মধ্যে একাডেমিক চর্চা ও গবেষণার প্রবণতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এসব পরিত্যাগ করতে হবে। ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করছে অসাধু ও স্বার্থপর কিছু রাজনীতিবিদ। রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে সন্ত্রাস-নির্ভর রাজনীতিবিদরা ছাত্রদের ব্যবহার করছে। যার পরিণতিতে, আজকের ছাত্রসমাজের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত, অস্ত্রবাজ, চাঁদাবাজ, ইভটিজার।
তবে এখনও আদর্শবান আছে কিছু অংশ। তাই ছাত্র রাজনীতির আদৌ প্রয়োজন আছে কি না বেশ চিন্তার বিষয়। একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে মূল চালিকা শক্তি হলেও, এখন সেই ভূমিকা কতটা রাখতে পারছে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো? এ প্রসঙ্গে আমার অভিমত, হ্যাঁ- যদি কেউ রাজনীতি করতেই চায়, তবে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করুক। কিন্তু বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির এমন কোন ভাল দিক নেই যে, এটাকে চালু রাখতে হবে।বরং শিক্ষাঙ্গনের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য, ছাত্রছাত্রীদের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করা সহ সব ধরনের অপরাধ বন্ধের জন্য আইন করে হলেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা একান্ত জরুরি বলে আমি মনে করি। আমি একটা কথাই জোর দিয়ে বলব, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই। আমাদের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর বিভিন্ন ইংরেজি-ভাষী দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছে। বিশ্বের নানা ধরনের কর্মক্ষেত্রে তাদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের এই মান আরও উন্নত করতে হলে দরকার উন্নততর পরিবেশ। রাজনৈতিক হট্টগোল থেকে মুক্ত আবহাওয়া।
দুঃখের বিষয়, আমরা আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করি। আমরা এমনিতেই পিছিয়ে থাকা একটি জাতি। যদি শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা উন্নত একটি মান অর্জন করতে পারি তবে তাই দিয়েই বিশ্বে জায়গা করে নেয়া সম্ভব। তাই শিক্ষার জায়গাটিতে আমাদের আরও মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সুন্দর একটি পড়াশোনার পরিবেশ রাখতে পারলে এখান থেকে আমাদের জাতির জন্য দক্ষ উন্নত মানবসম্পদ তৈরি হবে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিমুক্ত রাখাটা খুবই জরুরি।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স