সুপ্রভাত ডেস্ক »
কর্ণফুলী নদীর উত্তরে শহর এবং দক্ষিণে বোয়ালখালী উপজেলার গ্রামাঞ্চল নিয়ে চট্টগ্রাম-৮ সংসদীয় আসন। তীব্র তাপদাহের মধ্যে চলমান এ আসনের উপ নির্বাচনে শহরের চেয়ে গ্রামে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। তবে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচনী আমেজ অনেকটাই অনুপস্থিত। মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নৌকার প্রার্থী নোমান আল মাহমুদের সমর্থক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় ১৯০টি ভোটকেন্দ্রে ইলেকট্রন্কি ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ শুরু হয়, চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। খবর সারাবাংলা’র।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিলিয়ে মোট পাঁচজন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। প্রার্থীরা হলেন- নৌকা প্রতীকের নোমান আল মাহমুদ, চেয়ার প্রতীকে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সৈয়দ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, মোমবাতি প্রতীকে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ, আম প্রতীকে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপি’র কামাল পাশা এবং একতারা প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রমজান আলী।
ভোটগ্রহণ শুরুর পর সকালের দিকে শহর ও গ্রামের বিভিন্ন কেন্দ্রে স্বতঃস্ফূর্ত ভোটার উপস্থিতি ছিল। তবে সকাল গড়াতে রোদের তীব্রতা যখন বাড়তে থাকে, তখন শহরের কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কমতে থাকে।
বোয়ালখালী উপজেলা সদরের গোমদ-ী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে আটটি বুথে সকাল ১০টা পর্যন্ত ১৮০ জন ভোটার ভোট দেন। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. আতিক উল্লাহ জানান, এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৮৫৬ জন। নৌকা, মোমবাতি ও চেয়ার প্রতীকের প্রতিনিধি কেন্দ্রে উপস্থিত আছেন।
সারোয়াতলী ইউনিয়নের দক্ষিণ সারোয়াতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দিনভর ভোটারের উপস্থিতি ভালো দেখা গেছে। তবে সেই কেন্দ্রেও শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরই বেশি সক্রিয় দেখা গেছে।
ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সুমন আইচ বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ভালো। নিজেরাই নিজেদের আগ্রহে কেন্দ্রে আসছেন। ভোট দিচ্ছেন।’
পশ্চিম গোমদ-ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি থেকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠলে ১০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। ভোট দিয়ে ফেরার পথে রান্না করা বিরিয়ানিও বিলি করতে দেখা গেছে।
মোমবাতি প্রতীকের প্রার্থী সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ অভিযোগ করেছেন, উপজেলার আটটি কেন্দ্রে তার প্রতিনিধিদের ঢুকতে দেয়নি নৌকার সমর্থকরা।
পোপাদিয়া খাজা গরীবে নেওয়াজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে একই অভিযোগ ওঠার পর প্রিজাইডিং অফিসার এ কে এম হারুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘অভিযোগ সত্য নয়। নৌকা, মোমাবাতি ও চেয়ার প্রতীকের প্রতিনিধি কেন্দ্রে আছেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত শতাধিক ভোট পড়েছে।’
নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে বহদ্দারহাটের এখলাছুর রহমান সরকারী প্রাথমিক দিনভর ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে চান্দগাঁওয়ে সিডিএ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ ও শমসের পাড়া হাজী চান মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পাঁচলাইশে মোহাম্মদীয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি একেবারে কম দেখা গেছে।
দুপুরে এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ভোটের পরিস্থিতি খুব সুন্দর মনে হচ্ছে আমার। এলাকার লোকজন খুব সুশৃঙ্খলভাবে নির্বিঘেœ ভোট দিচ্ছেন।’
ইভিএম’র বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চলছে অভিযোগ করে মেয়র রেজাউল বলেন, ‘ইভিএমের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয় আসলে সেখানে কোনো ঝামেলা নেই, ধাক্কাধাক্কি নেই। আপনার ফিঙ্গারিং দিয়ে আপনি সত্যিকারের ভোটার কিনা তা যাচাই করা হবে। এরপর আপনার পছন্দের প্রতীকে সুন্দরভাবে ভোট দিতে পারবেন। এর থেকে সহজ সিস্টেম আর কি হতে পারে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সব সময় পেছনের কথা চিন্তা করি। এখানে ব্যালটের মতো কোন সীল লাগে না, কিছু লাগে না। শুধু ফিঙ্গারিং করে ভোট দিলাম। মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় লাগলো।’
এর আগে, সকাল ৮টায় একই কেন্দ্রে ভোট দেন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ। ভোটের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে নোমান আল মাহমুদ বলেন, ‘সকাল থেকে কেন্দ্রগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষ ভোট দিচ্ছে। আশা করি, জনগণ নৌকা প্রতীকে রায় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে অব্যহত রাখবেন।’
ভোটের মাঠ থেকে সারাবাংলা’র স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ইমরান চৌধুরী জানিয়েছেন, বোয়ালখালীর পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন কেন্দ্র থেকেও প্রতিনিধি বের করে দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন মোমবাতি প্রতীকের প্রার্থী সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। তিনি বলেন, ‘৫২ নম্বর খাজা গরীবে নেওয়াজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আমাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে আমরা শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকতে চাই।’
ভোট রাতে হয়ে গেছে বলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আতঙ্ক ছড়িয়েছে অভিযোগ করে আম প্রতীকের প্রার্থী কামাল পাশা বলেন, ‘সকাল থেকে ৪০টি কেন্দ্র ভিজিট করেছি। ভোটের সব সরঞ্জাম কেন্দ্রে আছে, কিন্তু মানুষ নেই। রাতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা সব কেন্দ্রে ঢুকে এক ঘন্টা অবস্থান করেছে। এজন্য সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়েছে যে রাতেই ভোট হয়ে গেছে। এজন্য সাধারণ মানুষের উপস্থিতি কম।’
‘আমাদের আশা ছিল এই উপ-নির্বাচনে যদি ভোট সুষ্ঠু হয় তাহলে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভোটও সুষ্ঠু হবে। কারণ অনেকেই ভোটার হয়েছে ১৫ বছর হয়েছে তবে ভোট দিতে পারেনি। আমিও গত ১০ বছর যাবৎ কোনো ভোট দিতে পারিনি। এবার ভেবেছিলাম সবার সাথে গিয়ে ভোট দেব। কিন্তু দূর্ভাগ্য প্রতিটি কেন্দ্রে গিয়ে দেখি কোনো মানুষ নেই।’
কর্ণফুলী নদীর উত্তরে মহানগরীর চান্দগাঁও ও পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামি থানার একাংশ এবং দক্ষিণে বোয়ালখালী উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৮ আসন। এ আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন। এর মধ্যে পুরুষ দুই লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৩ জন এবং দুই লাখ ৫৪ হাজার ১০৯ নারী।
নির্বাচনে ২২ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া দুজন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটও দায়িত্ব পালন করছেন। মোট ১৯০টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৬টি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ জন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন আছে। বাকি সাধারণ কেন্দ্রের প্রতিটিতে ১৬ জন সদস্য মোতায়েন আছে। পুলিশের পাশাপাশি র্যাবের ছয়টি ও পাঁচ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রয়েছে।
সকাল সাড়ে ১০টায় সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় নগরীর এখলাছুর রহমান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিডিএ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজসহ কয়েকটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, ‘ভোটাররা ভোট দিতে পারছে না- এরকম কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সুন্দর পরিবেশে ভোটগ্রহণ চলছে। খোঁজখবর নিয়ে দেখেছি, সব জায়গায় বিভিন্ন প্রার্থীর এজেন্টরা রয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি, র্যাব ও আনসার বাহিনী কাজ করেেছ। এছাড়াও জুডিশিয়াল এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।’
ভোটার উপস্থিতি গ্রামের তুলনায় শহরে কম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘ভোটার উপস্থিতি নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। আমরা ভোট দেয়ার জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছি। আমরা ভোটারদের বলছি, আপনারা আসুন, নির্বিঘেœ ভোট দিয়ে যান।’
৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। তিনিও ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০০৮ সাল থেকে পরপর তিন দফায় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরীক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর তিনি মারা গেলে চলতি মেয়াদের প্রথম দফায় আসনটি শূন্য হয়েছিল।