সাধন সরকার »
পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয় বাস্তব। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে জল ঘোলা কম হয়নি! একসময় পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল! কিন্তু ইতিহাস বলে, বাঙালি জাতি স্বপ্নের সাথে কখনো আপস করেনি। সকল জ¦ল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০১৩ সালের ৪ মে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেয় সরকার। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর পাইলিং কাজের উদ্বোধন করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানো হয়। এক একটি স্প্যান বসানোর সাথে সাথে স্বপ্ন যেন বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। গত ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ ৪১ তম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মার বুকে স্বপ্ন ডানা মেলেছে।
দেশের সর্ববৃহৎ এই প্রকল্পে ৯০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২২ সালের শুরুর দিকে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। বাঙালি জাতীয়তাবোধের শক্তি, আবেগ ও ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্নের নাম পদ্মা সেতু। পরনির্ভরশীলতার পরাকাষ্ঠায় আবদ্ধ এক সময়ের বাঙালি জাতি সবসময় চেষ্টা করেছে শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার। তার সর্বশেষ উদাহরণ নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু। পৃথিবীর অন্যতম খর¯্রােতা নদীর ওপর পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো নির্মাণ চ্যালেঞ্জের হলেও কখনো আশা হারায়নি বাংলাদেশ। বিশে^র গভীরতম পাইলের সেতু ‘পদ্মা বহুমুখী প্রকল্প’। করোনা-কালের মধ্যেও কাজ অব্যাহত রাখার ফলে স্বপ্নের সেতু বাস্তবে রূপ পেয়েছে। দেশের দীর্ঘতম ৬.১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে ইতিমধ্যে বদলে যেতে শুরু করেছে পদ্মাপাড়ের জীবন। দুপাড়ের মানুষের জীবনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। অন্ধকার-অশুভ শক্তি যতই জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরুক না কেন সকল বাধা পেরিয়ে আলো আসবেই। বিশ^ দরবারে বাংলাদেশের গৌরবকে মহিমান্বিত করার নাম পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তো বটেই পুরো দেশের অর্থনীতির চিত্র বদলে যাবে। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের মধ্য দিয়ে খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের মোট ২১ জেলার প্রায় ৩ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে তিন দিকে তিনটি মহাসড়ক খুলনা, বরিশাল, রাজবাড়ী, যশোরের দিকে চলে গেছে। যা মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসহ বেনাপোল স্থলবন্দরকে যুক্ত করেছে।
অদম্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্ষমতার স্বরূপ তুলে ধরেছে পদ্মা সেতু। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নয় পুরো দেশের সাথে একটা সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠবে এর মাধ্যমে। এ সেতু চালু হওয়ার সাথে সাথে কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষা-অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে। পদ্মা সেতুর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। এ সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য আরও গতি লাভ করবে। পদ্মার দুপাড়ে শিল্পায়ন, বাণিজ্যিক কর্মকা- বৃদ্ধি, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ব্যাপক প্রসার লাভ করবে। ঢাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গড় দূরত্ব কমে যাবে। মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ সাশ্রয় হওয়ার পাশাপাশি আমদানি ও জ¦ালানি ব্যয় ব্যাপকাংশে হ্রাস পাবে। এ সেতু হয়ে কৃষিপণ্য, গার্মেন্টস, পাট, হিমায়িত খাদ্য খুব দ্রুত ঢাকায় পরিবহন করা সম্ভব হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশ লাভে পদ্মা সেতু ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, পদ্মা সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অর্থনীতির ধনাত্মক পরিবর্তন বয়ে নিয়ে আসবে। এ সেতু মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরের গতি সঞ্চারের পাশাপাশি বিপরীতভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাবে। পদ্মা সেতুর বিশেষত্ব হলো- এটি দ্বিতল। সড়ক ও রেলপথ মিলিয়ে একসঙ্গে চিন্তা করলে পদ্মা সেতু বিশে^র প্রেক্ষাপটে বৃহৎ সেতুগুলোর একটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে বাড়তি প্রায় ২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি যুক্ত হবে। জাতীয়ভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়বে প্রায় ১ শতাংশ। পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশ আরও স্বল্প ও অতি সহজে প্রতিবেশী দেশসমূহে আমদানি-রপ্তানি করতে পারবে।
জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে ‘এসডিজি’ তথা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত সোনার বাংলা গঠনে পদ্মা সেতু ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যও হ্রাস পাবে। দক্ষিণাঞ্চল এমনিতেই দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে এ অঞ্চলে উন্নয়ন টেকসই ভিত্তি পাচ্ছে না! দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন নিশ্চিত করতে হলে সেতু চালুর সাথে সাথে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। হতে পারে এটাই দেশের সবচেয়ে বড় শেষ সেতু!
তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও আছে! ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য উচ্চ হারে টোল আদায় করা হবে! ফলশ্রুতিতে এই টোল আদায়ের চাপ ও খরচ সরাসরি জনসাধারণের পকেট থেকেই যাবে! তাই শুরুতেই যানবাহনের টোল আদায় সহনীয় রাখা সমীচীন হলেই ভালো। উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ভালো দিকের পাশাপাশি পরিবেশের ওপর কিছু নেতিবাচক প্রভাব সবসময় পড়ে! পদ্মা নদীর ভাঙা-গড়ার খেলা প্রায় সময় চলমান থাকে। পদ্মার বুকে এত বড় সেতু নির্মাণের ফলে পলি পড়ে নদীর বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। যার ফলে জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও ঋণাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। নদীর প্রবাহ যাতে সচল থাকে এ ব্যাপারে এখনই পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বিশে^র দরবারে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তির প্রসার হয়েছে। বুকভরা গর্ব আর চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি জাতি এখন বলতে পারবে-আমরাও পারি! পদ্মা সেতু নির্মাণ যেন স্বপ্নের সাথে আপস না করা এক জয়ের গল্প। টুকরো টুকরো স্বপ্নের পালে হাওয়া দিয়ে বাংলাদেশ বিশে^র দরবারে সর্বক্ষেত্রে এভাবেই মর্যাদার আসনে আসীন হবে- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও পরিবেশকর্মী
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স