রোমন্থন

মাকসুদুর রহমান »

হোটেলের বারান্দা থেকে কুয়াকাটার আকাশটা আধভাঙা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। অজগরের মতো ওলট-পালট খাওয়া সাগরের ঢেউগুলো সৈকতের বালিকে ভিজিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে আপন আলয়ে। তিরতির করে মেঘেরা এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে দলছুট ঘোড়ার মতো। একটা মেঘের দল এসে চাঁদকে বুকে নিচ্ছে আরেকটা দল আসার আগে-আগে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা দমকা হিমেল হাওয়া আলিঙ্গন করে গেল। নোহা এক কাপ কফি এগিয়ে দিয়ে চেয়ার টেনে পাশে বসলো। আমি ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে লহরির ঐকতান আর মেঘেদের লুকোচুরি খেলায় বুঁদ হয়ে গেলাম। হঠাৎ নোহা বলে উঠল, মারুফ, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
আমি ওপর-নিচ মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
তুমি কী মনে করতে পারো আজ থেকে ঠিক কত বছর আগে আমাকে প্রথম দেখেছিলে?
অন্তত পাঁচ-ছয় বছর তো হবে।
এখনও কি মনে আছে সেইদিনটা?
নানাভাবে, নানাঢঙে অনেকবারই তো দেখা। অসংখ্য স্মৃতির মাঝে একটা স্মৃতি চোখের পর্দায় এখনও জলেভাসা পদ্মের মতো টলটল করছে। একেবারে তরতাজা। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন। তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যাব-যাব করছে আর তুমি বোধহয় ফার্স্ট সেমিস্টার আর সেকেন্ড সেমিস্টারের সন্ধিক্ষণে। ক্লাস শেষে আমরা শহরমুখী বন্ধুরা দফারফা করে নিয়েছিলাম লেডিস ঝুপড়ির সিদ্দিকের দোকানে লাঞ্চ সেরে জমিয়ে আড্ডা দিয়ে চারটার শাটলে ব্যাক করবো। ডিপার্টমেন্টে একটা কাজ পড়ে গেল আমার। সবাইকে ঝুপড়িতে পাঠিয়ে কাজ সেরে সমাজবিজ্ঞান ফ্যাকাল্টি থেকে বের হতে না হতেই ইসমাইলের ফোন, সে আড়াইটার শাটলে ব্যাক করবে। আমি সমস্ত বন্দোবস্ত বাদ দিয়ে তার সাথে ব্যাক করার তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘড়ির কাঁটা আড়াইটা ছুঁই ছুঁই। ট্রেন পাব কি পাবো না ভীষণ দ্বিধায়। তড়িঘড়ি করে স্টেশনে এসে পৌঁছালাম ঠিক সময়ে। শ্রাবণ মাসের শুরু অথচ বৃষ্টির ছিটেফোঁটাও নেই। রোদের দাঁত ভীষণ ধারালো বিধায় গরমে হাঁসফাঁস করতে-করতে কুলকুল করে ঘামছিলাম। তাই আমার মন আকুলি-বিকুলি করে উঠেছিল যেন চারটার ট্রেনেই ফেরি করে বসি। ইসমাইলকে রাজিও করিয়েছিলাম এক প্রকার। ততক্ষণ কালাম মামার দোকানে আড্ডা দেব আর গরম গরম পেঁয়াজু, সিঙাড়া সাবাড় করবো। আমরা দুজন হাঁটছিলাম প্ল্যাটফর্মে। হুঁইসেল বাজিয়ে শাটল এগুতে শুরু করলো ধীর লয়ে। শহরমুখী ছাত্রেরা মোটামুটি একটা ম্যারাথন দৌড় শুরু করলো। হাঁটতে-হাঁটতে আমরা কেন জানি অগত্যা সামনের বগিটাতে উঠে পড়লাম। উঠেই আশেপাশে অসংখ্য মেয়ের মধ্য থেকে আমার চোখ দুটো পালিয়ে গেল তোমার দিকে। চমৎকার কায়দায় পরা নীল হিজাব আর কালো মাস্কের উপত্যকায় সুকুমার ভুরুর নিচে দুটি দ্বিধাহীন ছায়াময় চোখ শিশুর চোখের মতো পিটপিট করছিল। আমার মনের শিরায়-শিরায় একটা তিরতিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেটা ছিল তোমার আমার প্রথম চোখাচোখি। সেদিন কী গভীর আনন্দ আমাকে অভিভূত করেছিল!
এরপর থেকে তোমাকে দেখার কত আয়োজন আমার। কত অপেক্ষার পর, কতদিন গড়ানোর পর হঠাৎ একদিন আষাঢ়ের রোদ্দুর হয়ে দেখা দিতে তুমি। সমস্ত হৃদয়জুড়ে বয়ে যেত আনন্দের হিল্লোল। কালেভদ্রে যখন তোমাকে দেখতাম, মনে হতো প্রেমে পড়ার চেয়ে আনন্দ বুঝি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। তোমাকে এক পলক দেখার আনন্দে আমার হৃদয়ের আকাশ থেকে গলে-গলে জোছনা পড়তো।
নোহার গাল ইষৎ লালচে, দৃষ্টি তীক্ষè অথচ মেজাজ ফুরফুরে। গলাখাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, পাগল, কফি বুঝি ঠান্ডা হয়ে গেল। কাপটা দাও, রেখে আসি।
আমি শরবতের মতো একটানে শেষ করে তার হাতে কাপটা দিলাম। ছটফট রেখে এসে মোলায়েম গলায় সে আবদার করে বসলো, চলো না সমুদ্রে পাটা ভিজিয়ে আসি
জোয়ারে সমুদ্রটা এখন প্রায় কূলের নিকটবর্তী। শোঁ শোঁ শব্দে কানের পাশ দিয়ে অবারিত বাতাস বইছে। ছোট-বড় অসংখ্য মাথাভাঙা ঢেউ ডেকে-ডেকে যাচ্ছে জোর গলায়। দরদমাখা এই আবেদন উপেক্ষা করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেননি। গাঁয়ের ভুলপুকুরের মতো সমুদ্রের ঘোলাটে জল পা ছুঁয়ে প্রণাম জানিয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ। কুয়াকাটার আকাশজুড়ে ঘন কালো মেঘ একে একে জড়ো হচ্ছে অনেকটা নিচে এসে। মেঘে-মেঘে ঘর্ষণে কাছে-দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নেমে এসেছে তরল অন্ধকার। নোহা খোঁপা খুলে দিল। তার সুগন্ধি ছড়ানো চুলগুলো পাখির ছানার মতো উড়ু-উড়ু করছে। কিছু চুল আমার নাকে-মুখে বাড়ি খেতে লাগলো। আন্ধারমানিক নদীর মোহনায় জেলেদের নৌকার আলো জোনাকির আলো হয়ে জ্বলে-জ্বলে উঠছে, যেমন করে বিজলির আলোয় ঝিলিক দিয়ে জ্বলে উঠছে নোহার হীরের নাকফুলটি।