নিজস্ব প্রতিনিধি, রাউজান »
হালদা নদীতে ডিম ছেড়েছে মা-মাছ। অনেক প্রতীক্ষার পর গত রোববার দিবাগত রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সময়ে হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়ে। ডিম সংগ্রহকারীরা হালদা নদী থেকে নৌকা ও জাল নিয়ে উৎসবের আমেজে ডিম সংগ্রহ করে। এত ডিম দিয়েছে, প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি বলছেন জেলেরা। বরং সংগ্রহের সক্ষমতার চেয়ে বেশি হওয়ায় আরও ডিম নদীতে রেখেই তাদের ফিরতে হয়েছে। যদিও এখনও নির্ধারণ হয়নি, তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন- এবার ডিম সংগ্রহের পরিমাণ গত তিন বছরের রেকর্ড ছাড়াবে। রাউজান-হাটহাজারী উপজেলার ৩০৮ জন ১৫৫টি নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহ করেছে।
রাউজান-হাটহাজারীর ডিম সংগ্রহকারীরা গতকাল দুপুর পর্যন্ত ১৪ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করেছে। যেটি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।
প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে আমবস্যার জো চলাকালে ১৮ জুন দুপুরে বিকালে প্রথমে মা মাছ নমুনা ডিম ছাড়ে। এরপর সংগ্রহকারীরা নৌকা ও জাল নিয়ে হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহ করার প্রস্তুতি নেয়। রোববার দিবাগত রাত ১২টা থেকে মা-মাছ ডিম ছাড়ে। হালদা নদীর রাউজানের পশ্চিম গহিরা অংকুরী ঘোনা, দক্ষিণ গহিরা, গহিরা মোবারকখীল, পশ্চিম বিনাজুরী, কাগতিয়া, আজিমের ঘাট, মগদাই, পশ্চিম আবুর খীল নাপিতের ঘাট, উরকিরচর, হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা, নয়াহাট, রামদাশ হাট, বাড়িঘোনা, মাছুয়া ঘোনা, আমতোয়া, শাহ মাদারী, মাছুয়াঘোনা এলাকায় হালদা নদী থেকে ডিম সংগ্রহ করা হয়।
গতকাল সোমবার ভোররাতে রাউজানের গহিরা মোবারক খীল হ্যচারি ও পশ্চিম বিনাজুরী আই.ডি.এফের হ্যচারি, হাটহাজারীর মদুনাঘাট, মাছুয়া ঘোনা, শাহ মাদারী হ্যচ্যারিতে ও হালদা নদীর বিভিন্ন স্পটে নদীর তীরে খনন করা মাটির কুয়ায় ডিম রেখে ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম ফুটানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। রাউজানের দক্ষিণ গহিরা মোবারক খীল এলাকার ডিম সংগ্রহকারী আবু বক্কর বলেন, গত রোববার দিবাগত রাত ১২ থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত চারটি নৌকা নিয়ে ৩০ বালতি ডিম সংগ্রহ করেছি। ডিম সংগ্রহকারী এমদাদ ৪টি নৌকা নিয়ে ৩০ বালতি ডিম সংগ্রহ করে বলে জানান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও প্রতিবছর ডিম সংগ্রহের পরিমাণ নির্ধারণ করেন। ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘একক নৌকাভিত্তিক ডিম সংগ্রহের পরিমাণ এবার খুব ভালো। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। আমরা সরকারি কমিটির সঙ্গে মিলে পরবর্তীতে সংগ্রহের পরিমাণ নির্ধারণ করব।’
হালদা গবেষক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে ১৮ জুন মধ্যরাতে জোয়ারের সময় আমতুয়া পয়েন্টে কার্পজাতীয় মা মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়ে। এরপর এই ডিম জোয়ার বাড়ার সাথে সাথে নাপিতের ঘাট, আজিমারঘাট, মাছুয়াঘোনা হ্যাচারি সংলগ্ন পুরালি স্লুইজ গেইট, নোয়াহাটসহ হালদার বিভিন্ন স্পনিং গ্রাউন্ডে এই ডিম ছড়িয়ে পড়ে। শনিবারে বজ্রপাতসহ ব্যাপক বৃষ্টির প্রভাবে হালদায় পাহাড়ি ঢল নেমে এসে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এবার হালদা নদী থেকে প্রচুর পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।
ডিম সংগ্রহকারীরা হ্যচারিতে ও নদীর তীরে খনন করা মাটির কুয়ায় ডিম ফুটানোর কার্যক্রম শুরু করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষিত চট্টগ্রামের হালদা নদী।
বছরের এই সময়ে (এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন পর্যন্ত) বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ।
নদীতে মা মাছের ছাড়া সেই নিষিক্ত ডিম বিশেষ ধরনের জাল দিয়ে সংগ্রহ করে ডিম সংগ্রহকারীরা। পরে হ্যাচারিতে রেনু তৈরি করা হয়।
এবার এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে হালদায় মা মাছের আনাগোনা বাড়ে। তারপর প্রতিবার অমাবস্যা ও পূর্ণিমার তিথিতে ডিম সংগ্রহকারীরা নদীতে গেছে। কিন্তু ডিম ছাড়েনি মা মাছ।
এবার গ্রীষ্মে তীব্র তাপদাহ, বৃষ্টি না থাকা, হালদা ও কর্ণফুলীতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, কাপ্তাই লেকের পানি প্রবাহ কমে যাওয়াসহ নানা নেতিবাচক সূচক ছিল মৌসুম জুড়েই।
সবশেষ ১৮ মে নমুনা ডিম ছাড়লেও প্রায় এক মাস পর ডিম ছাড়লো হালদা নদীর কার্প জাতীয় কাতাল, রুই, মৃগেল ও কালিবাউশ মাছ।
গত কয়েক বছরের মধ্যে শুধু ২০১৮ সালে এপ্রিল মাসে মা মাছ ডিম ছেড়েছিল। এছাড়া বাকি চার বছরই মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে মা মাছ ডিম ছাড়ে।
চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে আছে হালদা নদী। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে হালদায় রেকর্ড পরিমাণ ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি এবং ২০১৮ সালে ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল।
এ ছাড়া ২০২২ সালে ৮ হাজার কেজি , ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর আগে ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।