রাত্রির রঁদেভু

জোবায়ের রাজু »

বিকেলে বাবা এক হাজার টাকার একটি নতুন নোট আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘আজই ল্যাবে গিয়ে মস্তিষ্ক পরীক্ষা কর। কেনো বারবার মাথা ঘুরে! তোর কিচ্ছু হলে আমাকে বুড়া বয়সে কে দেখবে!’ বড় করুণ শোনাচ্ছিল বাবার গলাটা তখন। এক হাজার টাকার নোটটি হাতে নিতেই বুকটা ভেঙে উঠল। আমার অকারণে মাথা ঘুরে ওঠে কেনো, সেটা টেস্ট করতে ল্যাবে যাব, এই অজুহাত দেখিয়ে আমার রিকশাওয়ালা বাবার কাছ থেকে আজ টাকাটা আদায় করেই ছেড়েছি।

ভাড়া বাইতে বাবা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ভালো জামাটি পরে আমিও চলে এলাম বাজারে। একটি গিফট শপ থেকে সাড়ে সাত’শ টাকায় সুন্দর পুতুল আর দু’বাক্স চকোলেট কিনে রওনা দিলাম মিজানদের বাড়ি। আজ মিজানের মেয়ে আদিলার জন্মদিন। আমাকে নিমন্ত্রণ করেছে। জন্মদিনের উপহারের কথা চিন্তা করে প্রথমেই না করে দিলাম। মিজানরা বড়লোক। চোখে লাগা কোনো গিফট না হলে নিজেকে খাটো মনে হবে। তাই না যাওয়ার সিন্ধান্ত নিলাম। কিন্তু মিজান ছাড়ছে না। যেতেই হবে। শেষে মাথা বারবার ঘুরে ওঠার কাল্পনিক রোগ দেখিয়ে বাবার কাছ থেকে এক হাজার টাকা আদায় করতে বাধ্য হলাম। রিকশা চালিয়ে বাবা টাকাটার ব্যবস্থা করলেন।

মিজানের সাথে পরিচয় ফেসবুকে। সেখান থেকেই সম্পর্কের শুরু। খুব সাধারণ ঘরের একটা ছেলে জেনেও মিজানের মত বড়ঘরের ছেলে আমাকে যথেষ্ঠ মূল্যায়ন করে। ওদের গ্রামের নামÑআফুলশী। আমার থেকে তিন কিলো দূরে।

২.

সন্ধ্যায় মিজানদের বাড়ি এসে দেখি জন্মদিনের আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। মিজান বাড়ি নেই, অর্ডার দেয়া কেকটি আনতে বাজারে গেছে। বেশ কিছু অতিথিদের সাথে সোফায় বসে আছি। একসময় কেক নিয়ে মিজান এলো। আমাদের কুশল বিনিময় হল। আমার আগমনে মিজান খুশি।

সন্ধ্যায় উঠোনে এসে কে যেন মিজানকে ডেকে নিয়ে গেল। সেখানে যাবার কিছুক্ষণ পর মিজানের উঁচু গলা শোনে বোঝা গেল মিজান কারো সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়েছে। ঘটনা পরখ করতে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। উঠোনে মিজান যার সাথে তর্ক করছে, তিনি আমার বাবা। চাঁদের আলোয় বাবার মুখটি দেখা যাচ্ছে।

দুজনের তর্ক শোনে বুঝলাম মিজান আমার বাবার রিকশায় চড়ে বাড়ি এসে ভাড়া হিসেবে বাবাকে যে ১০০ টাকার নোটটি দিয়েছে, সেটার অর্ধেক ছেঁড়া। বাবা প্রথমে বুঝতে পারেননি। মিজান টাকাটা দিয়ে বাড়ি চলে আসার পর বাবা আবিস্কার করলেন টাকাটার সিংহভাগ ছেঁড়া। সেই টাকা ফেরত দিয়ে নতুন টাকার আশায় বাবা সোজা মিজানদের বাড়ির ভেতরে চলে এলেন।

দুজনের তর্ক বাড়ছে। মিজান কিছুতেই টাকাটা নেবে না। বাবাও নাছোড়বান্দা। তর্কের এক পর্যায়ে মিজান বাবার শার্টের কলার চেপে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘মাতাব্বরি করতে এসেছিস? যা ভাগ!’ মলিন মুখের পরাজিত বাবা আর কথা বাড়ালেন না। মিজানের ঝাঁকিতে বাবার শার্টের কলার ছিঁড়ে গেল। নিরস মুখে চলে যাওয়া বাবাকে জানালা দিয়ে দেখে আমার চোখ ভিজে এলো।

মিজান ঘরে বলল, ‘এই ছোটলোকটার জন্যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।’ মিজানের দিকে তাকিয়ে আমি গোপনে চোখ মুছি।

৩.

কুঁড়েঘরের কপাটহীন জানালা দিয়ে মধ্যরাতের চাঁদের আলো এসে আমাদের অভাবের ঘরে পড়েছে। কলতলা থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে বাবা আমাকে বললেন, ‘মাথা পরীক্ষা করেছিস? কী এসেছে রিপোর্টে?’ তরল গলায় বললাম, ‘সমস্যা কিছু নেই।’ বাবার স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল।

গায়ের শার্টটি বাবা আলনাতে রেখে দিলেন। শার্টের কলার ছেঁড়া। হাহাকারে বুক ভেঙে গেল আমার। আলনার পাশে গিয়ে শার্টটি স্পর্শ করলাম। পাশে দাঁড়ানো বাবাকে প্রশ্ন করি, ‘এটা ছিঁড়ে গেল কিভাবে?’ বাবা মৃদু হেসে বললেন, ‘রিকশা বাইতে গরম লাগছিল। খুলতেই কাঁত করে ছিঁড়ে গেল।’ আমি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকি। কত যতœ করে মিথ্যে বলছেন বাবা। ছোটবেলায় স্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসে বাবাকে মিথ্যে করে বলতাম, ‘সবগুলি কেলাস করেছি।’ বাবা বুঝতে পেরে শাসনের সুরে বলতেন, ‘মিথ্যে বলা মহাপাপ।’ এতো বছর পর সেই বাবা এখন মিথ্যে বলছেন। শার্টের কলার ছিঁড়ে যাওয়ার মিথ্যে গল্প। বাবা জানেন না আমি মিজানদের জানালা দিয়ে সব দেখেছি।