সুপ্রভাত ডেস্ক »
নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক তরুণ নিহত হয়েছেন; আহত হয়েছেন শতাধিক। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর দুই নম্বর রেলগেট এলাকায় শুরু হয়ে চার রাস্তার মোড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এই সংঘর্ষ। আহতদের মধ্যে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী, পুলিশ, শিক্ষার্থী ও সাধারণ লোকজনও রয়েছেন। খবর বিডিনিউজের।
নিহত শাওন প্রধান (২০) নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার এনায়েতনগর ও বক্তাবলী ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী পূর্ব গোপালনগরের প্রয়াত সাহেব আলীর ছেলে। নবীনগর শাহ্ওয়ার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে তাদের একতলা বাড়ি।
আহতদের মধ্যে অন্তত ২৪ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানান হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক নাজমুল হাসান বিপুল। তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন মারা গেছেন। তার বুকের বাঁ পাশে একটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া ২৮ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৩-২৪ জন গুলিবিদ্ধ ছিল। কয়েকজন স্কুলশিক্ষার্থীও টিয়ারগ্যাসের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলের ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা সকাল ১০টায় নগরীর ডিআইটিতে আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনের সামনে থেকে শোভাযাত্রা বের করার প্রস্তুতি নেন। এতে পুলিশ বাধা দিলে বাধা উপেক্ষা করে বিএনপির মিছিল পাঠাগারের সামনে থেকে শহরের দুই নম্বর রেলগেট এলাকায় যাওয়ার চেষ্টা করেন।
এ সময় পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করলে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা দুই নম্বর রেলগেইট এলাকায় চাররাস্তার মোড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েন। রেললাইনের পাশে থাকা ইট-পাটকেল সংগ্রহ করে তারা পুলিশের উপর ছুড়তে শুরু করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, হাজারো নেতা-কর্মীর ইট-পাটকেলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। তারা পিছু হঠতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্য দুই নম্বর রেল গেইটের পুলিশ বক্সে অবস্থান নেন। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশ বক্সে ইট-পাটকেল মারতে থাকেন। সড়কের উপর কিছু যানবাহন ভাঙচুর করেন। দুটি মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে সদর থানার দিক থেকে একদল পুলিশ গুলি ছুড়তে ছুড়তে আসতে থাকে।
পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দফায় দফায় চলে এই সংঘর্ষ। একদিক থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ইট-পাটকেল ছোড়ে, বিপরীতে পুলিশ টিয়ারশেল ও গুলি ছুড়তে থাকে। সংঘর্ষ চলাকালীন গুলশান হলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শাওন প্রধান।
পরীক্ষা চলাকালে স্কুলে টিয়ারগ্যাস, অসুস্থ ৪০ ছাত্রী নগরীর আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগারের পেছনেই মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সকাল ১০টা থেকে সেখানে অষ্টম ও দশম শ্রেণির ছাত্রীদের পরীক্ষা চলছিল। নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম চলছিল একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীদের।
বেলা ১১টার দিকে বিএনপি ও পুলিশের সংঘর্ষ চলাকালীন পুলিশের একটি টিয়ারশেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির মাঠে এসে পড়ে। মুহূর্তে কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। টিয়ারগ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন অন্তত ৪০ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে বারোজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক এম কবির ইউ চৌধুরী বলেন, সকাল ১০টা থেকে অষ্টম ও দশম শ্রেণির মডেল টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়। একই সময়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শ্রেণি কার্যক্রম চলছিল।
তিনি জানান, সংঘর্ষে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ছাত্রী ও শিক্ষকরা। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের ছোড়া একটি টিয়ারশেল স্কুলের মাঠে এসে পড়ে। টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় অন্তত ৪০ জন ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে কয়েকজন অজ্ঞান হয়ে যান। ১২ জন ছাত্রীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অন্যদের শিক্ষকরাই প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
এই শিক্ষক আরও বলেন, ছাত্রীরা এক ঘণ্টাও পরীক্ষা দিতে পারেনি। গুলির শব্দে সকলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ছাত্রীদের সকলকে অভিভাবক ডেকে বাড়িতে পাঠানো হয়। পরবর্তী শিফটেও পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। সবই স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় অচেতন হয়ে পড়েন দশম শ্রেণির ছাত্রী আয়শা সুলতানা মিম (১৫)। তার ছোটবোন একই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তাসিন জাহান লামিয়াও গুলির শব্দে ভীত হয়ে পড়েন বলে জানান।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মিম ও লামিয়ার মা পারভীন সুলতানা বলেন, ‘স্কুলের এক টিচারের ফোন পেয়ে হাসপাতালে এসে দেখি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে আছে। স্কুলে নাকি টিয়ার গ্যাস মারছিল পুলিশ। সেই গ্যাসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হাসপাতালে আনার ১৫-২০ মিনিট পর আমার মেয়ের জ্ঞান ফেরে।’
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত পরীক্ষা ছিল। এক ঘণ্টাও হয়নি – এমন সময় গুলির শব্দ শুনতে পাই। এতে ক্লাসের সবাই ভয় পেয়ে যায়। স্কুলের ৫-৬ জন ছাত্রী গ্যাসের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে পড়ে।’
মর্গ্যান গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ছাত্রীরা এখন সুস্থ আছে। স্কুলের পক্ষ থেকে তাদের খোঁজ নেওয়া হয়েছে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টিয়ার শেল ছোড়ার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথেও আলাপ করা হবে।
সংঘর্ষের বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশে মিটিং মিছিল করার ক্ষেত্রে অনুমতির প্রয়োজন হয়। আজ (বৃহস্পতিবার) বিএনপির আয়োজন আছে সেটা আমরা জানি না, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখানে উনার প্রতিনিধি আছে তারাও কিছু জানে না। আমরা বলেছিলাম, এটা যেহেতু শহরের প্রধান সড়ক এবং প্রাণকেন্দ্র – আপনাদের যদি করতে হয় তাহলে অন্যকিছু ভাবুন। কিন্তু রাস্তা অবরোধ করে, যানজট সৃষ্টি করে, জান-মালের ক্ষতি করে এটা করা যাবে না।’
এসপি বলেন, ‘তারা কথা না শুনে, বৃষ্টির মত এলোপাথারি ইট-পাথর ছুড়তে শুরু করে। আমাদের ১৩ জন সদস্য গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছে। তাদেরকে জানমালের ক্ষতি থেকে বিরত রাখতে আইনগত যে ব্যবস্থা গ্রহণ করার আমরা সেটাই করেছি।’
এদিকে জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবি বলেন, ‘আমাদের কোনো বিক্ষোভ কর্মসূচি বা অন্য কোনো কর্মসূচি না। একটি দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর র্যালি করতে হলে যে ধরনের নিয়ম মানতে হয় সেইটা আমরা করেছি। আমরা জেলা পুলিশ সুপার ও সদর থানায় চিঠি দিয়ে কর্মসূচির কথা সপ্তাহখানেক আগেই জানিয়েছি।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কর্মসূচি করতে দেবে না সেইটা তারা আগে বললেই হতো। সেইটা না করে শান্তিপূর্ণ একটি র্যালিতে হামলা চালিয়েছে পুলিশ। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এইভাবে চলতে পারে না। সাধারণ একটা র্যালিও করা যাবে না – তাহলে তো চলে না। বিনা উসকানিতে পুলিশ এই ঘটনা ঘটিয়েছে।’
এই বিএনপি নেতা বলেন, তিনি নিজেসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতা আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন গুলিবিদ্ধও হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাও গেছেন তাদের এক যুবদল কর্মী।