আহমেদ জুনাইদ, চবি »
রাত তখন ২টা। নেগেটিভ রক্ত লাগবে, নেগেটিভ রক্তের কেউ থাকলে আসুন। এভাবেই চিৎকার-আহাজারি চলছিলো চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এ অবস্থার মাঝে উপস্থিত কয়েকশত চবিয়ান, যাদের প্রত্যেকের রক্তের গ্রুপই নেগেটিভ। প্রত্যেকেই প্রস্তুত রক্ত দেওয়ার জন্য।
গতকাল রাতের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রটা ভিন্ন। অনেকেরই পরদিন পরীক্ষা আছে। কেউ সারাদিন ক্লাস, টিউশন শেষ করে ক্লান্তিকে বিদায় দিতে মাত্র ঘুমোতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের খবর। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা জানাচ্ছিলেন শতশত ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। বিশেষ করে নেগেটিভ রক্ত পাওয়াই যাচ্ছে না। সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে হাজির কয়েকশত চবি শিক্ষার্থী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন। কিন্তু রাতে শাটল বন্ধ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসও ব্যাবস্থা করতে দেরি হচ্ছিলো। কিন্তু এই মানবিক যোদ্ধারা বসে থাকেননি।
কয়েকজন নিজস্ব মোটরসাইকেলে করে, কেউ অন্যভাবে ছুটতে থাকেন চবি মেডিক্যালের দিকে। রাত ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া হয় একটি বাস, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা ভাড়া করেন কয়েকটি বাস। সবগুলো বাস হাজির চমেকে কয়েকশত রক্তযোদ্ধা নিয়ে। এক মুহূর্তের জন্যও আহতদের রক্তের অভাব বুঝতে দেননি তারা।
পরিস্থিতি বর্ণনা করে চবি শিক্ষার্থী মামুনুর রশিদ জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেলে শত শত স্বেচ্ছাসেবক নেগেটিভ রক্তের ডোনার লাগবে বলে চিৎকার করছে, হঠাৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকশত ডোনার আসে যাদের সবার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। যে রক্তের জন্য ৭/৮ দিন আগে থেকে খোঁজ করতে হয় সে রক্ত দিতে সিরিয়াল দিতে হচ্ছে। শহর থেকে ক্যাম্পাস দূরে হলেও ক্যাম্পাস থেকে বাস নিয়ে রক্ত দিতে আসে চবিয়ানরা।
রাতে রক্ত দিতে ক্যাম্পাস থেকে ছুটে যাওয়া শিক্ষার্থী আল আমিন সিফাত জানান, সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর, যখন ফেসবুকে দেখলাম জরুরি রক্তের দরকার এবং সবাই জিরো পয়েন্টে যাচ্ছে ভার্সিটি থেকে বাস দেবে সিএমসি যাওয়ার জন্য। দৌড়ে এসে দেখলাম অনেক শিক্ষার্থী রক্ত দিতে যাবে এবং তাদের মাঝে অনেক ছাত্রীও রয়েছে। ভার্সিটি থেকে ১ টা ২০ মিনিটে যে প্রথম বাস ছেড়ে যায় যেখানে প্রায় সবার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ। এর পরেও আরো দুইটি বাসে করে পালাক্রমে শিক্ষার্থীরা রক্ত দিতে চমেকে আসে। অনেকেই সারারাত অপেক্ষা করে সকাল বেলা রক্ত দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরেন।
শুধু রক্তদানেই সীমাবদ্ধ ছিলো না চবি শিক্ষার্থীরা। অনেকে করেছেন মুমূর্ষু রোগীদের বহন এবং লাশ প্যাকিং এর কাজ। অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ছাত্র শহীদুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়েই রাত ১১.৩০ এর দিকে আমি মেডিক্যালে চলে যাই। সেখানে অনেক স্বেচ্ছাসেবী ছিলো। কিন্তু পুড়ে যাওয়া মুমূর্ষু রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসার কাজ কিভাবে করতে হয় খুব কম মানুষই জানে। তাছাড়া কিছু রোগী ছিলো এতোটাই পোড়া যে তাদের বার্ন ইউনিট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। আমি এবং আমার বন্ধু তানভীর মিলে সেইসব রোগীকে সহযোগিতা করেছি। তাছাড়া রাত ৩টার দিকে বাড়তে থাকে লাশের সংখ্যা। পুড়ে যাওয়া গলিত লাশ ফাইল করতে কেউ পারছিলো না। হাসপাতালের অনেক স্টাফও লাশের অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারেনি। আমি এক ছোট রুমের মধ্যে থেকে ১৫টার মতো গলিত লাশ ফাইল করার কাজ করেছি।