নিজস্ব প্রতিবেদক »
দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় থাকা গভীর নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় পরিণত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছাকাছি এলাকায় সাগর বিক্ষুব্ধ থাকায় মোখা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে ধারণা করছেন আবহাওবিদরা। তাই মোখার বিপর্যয় ঠেকাতে চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলো গ্রহণ করেছে নানা প্রস্তুতি।
আবহাওয়া সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আগামী রোববার (১৪ মে) বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের চকপিউ শহরের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে স্থলভাগে আঘাত হানতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ এবং এটি কবে কোন এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চারটি ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। অ্যাপগুলো হবে জুম আর্থ, রেইনভিয়ার ডটকম, স্কাইমেট ওয়েদার ও স্কাইমেট ওয়েদার।
বিশেষজ্ঞদের মতে ঘূণিঝড়টি বাংলাদেশের টেকনাফ এবং মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এরপরও গতকাল বেলা ১২টার আবহওয়ার পূর্বাবাসে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে দুই নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
এ নিয়ে গতকাল দুপুর ৪টায় প্রধান আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়া আবহাওয়াবিদ মেঘনাথ তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (গতকাল) ভোরে মোখা গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড়টি এখনো কক্সবাজার থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার দূরে আছে। ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রভাগ রোববার (১৪ মে) সকাল ৬ টার পর থেকে দুপুর ১২ টার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলে আঘাত করার আশংকা করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্র দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ও পিছনের অংশ সন্ধ্যা থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত উপকূল অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে।’
ঘূর্ণিঝড় মোখা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং নিম্নোক্ত সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য চট্টগ্রামের পাঁচ সেবা সংস্থা নানা পরামর্শ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
জেলা প্রশাসন
জরুরি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও সিটি কর্পোরেশনে কন্ট্রোল রুম খোলা ও উপজেলা পর্যায়ে দ্রুত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা আয়োজন, স্ব স্ব এসওপি অনুযায়ী সকল দপ্তরের কার্যক্রম গ্রহণ, বিভিন্ন এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণমাধ্যমকে দুর্যোগ মোকাবেলায় অংশগ্রহণ, উপকূলবর্তী ও পাহাড়ি এলাকায় মানুষকে সচেতন করতে মাইকিং কার্যক্রম চলমান রাখাসহ যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার সাথে ও জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের নাম্বারে যোগাযোগ করার নির্দেশনা প্রদান করেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘সম্ভাব্য দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলার সম্ভাব্য প্রাথমিক চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম জেলার সকল (১৫টি) উপজেলায় ত্রাণ কার্য হিসেবে চাল ও নগদ টাকা বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। বিদ্যমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখা ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদেরকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
কন্ট্রোল রুম ও ৯০ আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে প্রস্তুত চসিক
নাগরিকদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে একটি কন্ট্রোলরুম ও ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এসব তথ্য জানিয়ে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘নগরের দামপাড়ায় এই কন্ট্রোল রুমের ০২৩-৩৩৩-৬৩০-৭৩৯ জরুরি সেবা নাম্বারে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য ও সেবা পাবেন চট্টগ্রামবাসী। ঘূণিঝড় মোখা নিয়ে চসিকে একটি সভা হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি কন্ট্রোলরুম চালু করা হয়েছে। এছাড়া ৪১টি ওয়ার্ডে ৯০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতকরা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রস্তুতি সভা করে সচেতনতামূলক মাইকিং করা হবে। পাশাপাশি আরবান মেডিক্যাল টিম, আরবান ভলান্টিয়ার ও উদ্ধারকর্মীদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় যানবাহন ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ও সড়কবাতি নির্বিঘœ রাখার জন্য প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের ১০ নির্দেশনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ১০টি নিদের্শনার কথা জানান। নির্দেশনাগুলো হলো- জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে পর্যাপ্ত মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা, খাবার স্যালাইনসহ জরুরি প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক ওষুধ ও উপকরণ উপকূলবর্তী জেলায় পর্যাপ্ত মজুত রাখা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং সাপে কাপড় দেওয়া রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক অ্যান্টিভেনম মজুত রাখা, উপকূলবর্তী এলাকায় মাঠকর্মীদের (স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, স্বাস্থ্য সহকারীসহ অন্যান্য) মাধ্যমে উপদ্রুত অঞ্চলে নিয়মিত পরিদর্শন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা, যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনে কর্মকর্তা/কর্মচারীর নৈমিত্তিক ছুটি বাতিলসহ প্রতিষ্ঠান প্রধান ও চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অবস্থান নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাম্বুলেন্সগুলো প্রয়োজনীয় জ্বালানিসহ প্রস্তুত রাখা, যেসব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স সচল আছে, সেসব ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স মেডিকেল টিম এবং প্রয়োজনীয় জ্বালানিসহ প্রস্তুত রাখা, নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু রাখা এবং সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
সীতাকুণ্ডে ফুটওভার ব্রিজের ডেকবিম স্থাপন স্থগিত
চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা মোখার সাম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের অধীন ঢাকা (যাত্রাবাড়ী)-কুমিল্লা (ময়নামতি)-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ জাতীয় মহাসড়কের (এন-১) ২০৯তম কিলোমিটারে সীতাকু- উপজেলার আরআর টেক্সটাইল এলাকায় নির্মাণাধীন ফুটওভার ব্রিজের ডেকবিম স্থাপন কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত মহাসড়কের ওই অংশে দুই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধের বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করার কথাও তিনি জানান।
পানি সরবরাহ ঠিক রাখতে ওয়াসার ৫ কন্ট্রোল রুম
নিরাপদ পানি সরবরাহ বজায় রাখাসহ গ্রাহকদের অভিযোগ গ্রহণ ও তাৎক্ষণিক সমাধানের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসা ৫টি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করেছে। চট্টগ্রাম ওয়াসার জনসংযোগ কর্মকর্তা কাজী নূরজাহান শীলার পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, কন্ট্রোল রুমের নাম্বারগুলো হলো- প্রধান কার্যালয়ে (দামপাড়া) ১৬১১৮/০৯৬০১২৫০০৮০০, মড-১ (আগ্রাবাদ) ০২৩৩৩৩২৫২৫২, মড -২ (মেহেদীবাগ) ০২৩৩৩৩৬৭৯৭৩, মড -৩ (কালুরঘাট) ০২৪১৩৮৮০০৬, মড -৪ (জুবিলী রোড) ০২৩৩৩৩৫৬৭৬৮।
এছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন দল নগরের উপকূলীয় অঞ্চলে সচেতনতামূলক মাইকিং কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এছাড়া তাদের জরুরি সেবায় ব্যবহৃত ফোন নাম্বারে (০২-৩৩৩৩১১১৫২ ও ০১৭৩০-৩৩৬৬৬৬) নাগরিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল হালিম। একইভাবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নাগরিক সেবা দিতে ০১৭৩০-৭২৮৪৪৪ নম্বরটি চালু রেখেছে বলে জানিয়েছে।