মৃত্যু ও শনাক্তে এপ্রিল শীর্ষে

তিনটি প্রধান কারণে সংক্রমণ বেড়েছে : ফজলে রাব্বী
উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত টেস্ট করান : আবদুর রব
ভরসার জায়গা মাস্কে : বিদ্যুৎ বড়ুয়া

কাঁকন দেব <<<
করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু এ দুই সূচকে এপ্রিল মাস ঊর্ধ্বমুখী। চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তের ১৩ তম মাসে এসে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত বছরের ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। এ বছরের এপ্রিলের প্রথম ২৫ দিনে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৯০০ জন। এ মাসে করোনা সংক্রমণ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জনের। মাস শেষে শনাক্ত ও মৃত্যু সংখ্যা আরও বাড়বে, এমন শঙ্কা অমূলক নয়।
গত এক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি মাসে সংক্রমণের তীব্রতা আসলেই ঊর্ধ্বমুখী। চট্টগ্রামে গত বছরের এপ্রিলে করোনা শনাক্তের প্রথম মাসে মোট সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৩ জনে আর মৃত্যু হয় ৬ জনের। মে মাসে সংক্রমণ হয় ২৯১২ জন ও মৃত্যু ৭০ জনের, জুন মাসে শনাক্ত ৫৪৯৫, মৃত্যু ৯৭; জুলাইয়ে শনাক্ত ৫৮৫৪ আর মৃত্যুবরণ করেন ৫৮ জন। আগস্টে ২৭১৪ জন আর মৃত্যু ৪০ জনের। সেপ্টেম্বরে রোগীর সংখ্যা ১৭৫৩ জন আর মৃত্যু ২১। অক্টোবরে পজিটিভ হন ২৩৭৯ আর মৃত্যু ১১। নভেম্বরে ৩৯৫১ আর মৃত্যু ১৬। ডিসেম্বরে ৫২০৪ আর মৃত্যু ৪০ জনের।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে মোট সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ২৬২৪ আর মৃত্যু ১০ জনের। ফেব্রুয়ারিতে শনাক্ত ১৯২৩ আর মৃত্যু ৪ জনের। মার্চে ৫১১০ আর মৃত্যু ১৩ জনের। চলতি মাস করোনা রোগী শনাক্তে ও মৃত্যুতে রেকর্ড করেছে।
১৩ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চট্টগ্রামে প্রথম রোগী শনাক্তের মাস বাদ দিলে সবচেয়ে কম রোগী শনাক্ত হয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে আর সবচেয়ে কম মৃত্যু হয় এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
গত বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলেও আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ কমতে শুরু করে। মাঝে নভেম্বর-ডিসেম্বর কিছুটা বাড়ে। এ বছরের প্রথম দুই মাস সংক্রমণ ও মৃত্যুহার হার কম থাকলেও মার্চে সংক্রমণে গতি পেয়ে এপ্রিলে রেকর্ড করেছে।
করোনা সংক্রমণ বাড়ার কারণ কী জানতে চাইলে সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী সুপ্রভাতকে বলেন, ‘তিনটি প্রধান কারণে সংক্রমণ বেড়েছে। প্রধানতম কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি না মানা। দ্বিতীয়ত, গরমে আমাদের দেশে সংক্রমণ বাড়ে। তৃতীয়ত, সামাজিক অনুষ্ঠান বেশি পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ গতি পেয়েছে। এছাড়া যারা বাসায় আক্রান্ত হন, অধিকাংশ আইসোলেশনে যায় না। সবার সাথে মেলামেশা করার ফলে পরিবারের সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। এটি এবার বেশি দেখা যাচ্ছে।’
করোনায় যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ
নগরের চকবাজার থানার জয়নগর, হালিশহর থানার রামপুর ওয়ার্ডের সবুজবাগ, নয়াবাজার, বউবাজার, ঈদগাহ, বসুন্ধরা এলাকা এবং পাহাড়তলী থানার ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ও ১২ সরাইপাড়া ওয়ার্ডের কিছু এলাকা উচ্চ সংক্রমণশীল এলাকার আওতায় পড়েছে। করোনা সংক্রমণে জেলার হাটহাজারী ও নগরের হালিশহর এলাকা শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া সংক্রমণ বাড়ার ক্ষেত্রে প্রথম দিকে রয়েছে কোতোয়ালী, পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও। উপজেলার মধ্যে রয়েছে সীতাকুণ্ড, পটিয়া ও রাউজান। এ বিষয়ে সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, ‘নগরের সিটি করপোরেশন এলাকায় ১২ ওয়ার্ড বাদে ২৯ ওয়ার্ডে সংক্রমণ বেশি’।
করোনায় যাদের মৃত্যু বেশি
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সর্বশেষ গতকালের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে করোনায় মৃতের সংখ্যা ৪৯৭ জন। এর মধ্যে ৩৬৫ জন পুরুষ ও ১৩২ জন নারী। ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সীদের মধ্যে করোনায় মারা গেছেন ১২৪ জন। ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে মারা গেছেন ২৭২ জন।
এছাড়া ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে করোনায় মারা গেছেন ৬৩ জন। ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে মারা গেছেন ২৩ জন। ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬ জন, ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী ৫ জন ও শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী ৪ জন করোনায় মারা গেছেন।
সিভিল সার্জন বলেন, ‘বয়স্করা বেশি মারা যাচ্ছেন। একই সাথে যাদের অন্যান্য রোগ রয়েছে, তাদের জন্য করোনায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি।’
চট্টগ্রামে করোনায় মৃত্যুবরণ করা ৪৯৭ জনের মধ্যে ৩৭০ জনই নগরের বাসিন্দা।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে নগরের কোতোয়ালী এলাকায়। এরপরে পাঁচলাইশে ২৮ জন, চান্দগাঁও ২৭ জন, চকবাজারে ১৯ জন।
এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১২৭ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে হাটহাজারী উপজেলায়। এরপরে সীতাকুণ্ডে ১৫ জন, পটিয়ায় ১৪ ও রাউজানে ১৪ জন।
গত বছরের তুলনায় এবার করোনার মৃত্যুর পার্থক্য কোন জায়গায়, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা বিভাগের প্রধান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মো. আবদুর রব সুপ্রভাতকে বলেন, ‘গত বছর করোনায় রক্তজমাট বেঁধে মৃত্যু বেশি ছিল। এবার দ্রুত ফুসফুস সংক্রমিত হচ্ছে। যেটা আশঙ্কার বিষয়, তা হলো রোগীদের মধ্যে এবার তেমন কোনো লক্ষণ নেই। সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করতে গেলে দেখা যায়, ফুসফুস ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো সময় এটা ৮০ শতাংশ। এটি মৃত্যুর বাড়ার বড় কারণ। ’
তিনি আরও বলেন, ‘যে কারও সামান্য উপসর্গ দেখা দিলে করোনা টেস্ট করাবেন, কোনো উপসর্গকে অবহেলা করা যাবে না। আপনি যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে যান, ভেতরে ভেতরে ফুসফুস সংক্রমিত হয়ে গেলে ঝুঁকি বাড়বে। যখন আপনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭০ থেকে ৭৫ নিচে নেমে যাবে, তখন আইসিইউ ম্যানেজ করতে করতে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। যদি অক্সিজেনের লেবেল ৯৪ এর নিচে নেমে যায়, তখনই যদি রোগী হাসপাতালে চলে আসেন, তাহলে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা পাওয়াটা সম্ভব। তাহলে মৃত্যুর হারটা অনেক কমে যাবে।’
করোনার উপসর্গ ও মৃত্যুর কারণ
চিকিৎসকরা বলছেন, উপসর্গহীনরা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। করোনায় যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক ব্যক্তি। অথচ এ সময় বয়স্করা ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। আসলে উপসর্গহীন ব্যক্তিরা তার পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। যারা বয়সে তরুণ, তারা করোনায় সংক্রমিত হলেও উপসর্গ থাকে না।
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বেশি বয়স, ডায়াবেটিস, স্থূলতা ও হৃদরোগ। আন্তর্জাতিক গবেষণায় শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টিও ওঠে এসেছে।
করোনায় পুরানো উপসর্গের মধ্যে ছিল গলা খুসখুস, গলা শুকিয়ে যাওয়া, শুকনো কাশি, গন্ধ-স্বাদহীনতা, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। এবার যোগ হয়েছে শুধুমাত্র পেটের গণ্ডগোল, শুধুমাত্র মাথাব্যথা, শুনতে সমস্যা হওয়া, বমি, শারীরিক দুর্বলতা ও পিঠে বা কোমরে ব্যথা।
করোনার হটস্পট
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বাজার এবং গণপরিবহন। দেশে এখন পর্যন্ত যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের বড় অংশ হয় বাজারে গেছেন, নয়তো গণপরিবহন ব্যবহার করেছেন।
যেসব জায়গা থেকে মানুষ বেশি সংক্রমিত হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে উপাসনালয়, সভা-সেমিনারের মতো জনসমাগমস্থল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে ভ্রমণ, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া এবং পর্যটনকেন্দ্র। রোগীদের হিস্ট্রি (ইতিহাস) পর্যালোচনা করে সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এসব উৎসস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে।
করোনা সুরক্ষায় করণীয়
করোনা চিকিৎসায় প্রথম থেকে কাজ করেছেন চট্টগ্রামে ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা এবং বর্তমানে হোম সার্ভিসের মাধ্যমে রোগীদের সেবা দেওয়া ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। তিনি এখনও করোনা আক্রান্ত হননি। এটার কারণ কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যত্ন সহকারে মাস্ক পরিধান করি, এটা আমার ভরসার জায়গা। কোনো রোগীকে স্পর্শ করার আগে হাত স্যানিটাইজ করি, তাদের স্পর্শ করার পরও হাত স্যানিটাইজ করি। এতোদিনে এটা বুঝেছি, সঠিকভাবে মাস্ক পরলে ও বারবার হাত স্যানিটাইজ করলে করোনা আক্রান্ত থেকে দূরে থাকা যায়। আপনাকে প্রতি মূহূর্ত সতর্ক থাকতে হবে।’
করোনা সুরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণবিষয়ক সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, প্রথমে সঠিক নিয়মে মাস্ক পরিধান করুন। ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন ও যেখানে বেশি লোকের সমাগম সেসব স্থান এড়িয়ে চলুন। আপনি যদি ভ্যাকসিন নেওয়ার যোগ্য হন, দ্রুত নিয়ে নিন। এমন জায়গায় অবস্থান করুন, যেখানে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া প্রয়োজনে বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস বজায় রাখুন।