আবদুল মান্নান »
আরবিতে ‘উম্মাহ’ বলে একটা শব্দ আছে যার অর্থ সমাজ বা সম্প্রদায় ইংরেজিতে যাকে বলে কমিউনিটি। মুসলিম দুনিয়ার রাজনীতিবিদ, শাসক গোষ্ঠী বা ধর্মীয় নেতারা সুযোগ পেলেই এই শব্দটা অহরহ ব্যবহার করে আর ‘উম্মাহ’র একতার কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। কিন্তু গত চৌদ্দশ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে কোন কালে বা কোন অঞ্চলে এমন একতার তেমন কোন উদাহরণ পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলমান মুসলমান মারামারি কাটাকাটি আর যুদ্ধ করে যত মুসলমানের মৃত্যু হয়েছে তা অন্য কোন ধর্মাবলম্বিদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত ওসমানিয় (ওটোমান) সাম্রাজ্য পরবর্তি সাত শত বছর উত্তর আফ্রিকা হতে শুরু করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত একটি বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিল। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোন সাম্রাজ্য এত বড় আর দীর্ঘ সময় ধরে শাসন করেনি। ওসমানিয় শাসনের কেন্দ্রস্থল ছিল বর্তমান ইস্তাম্বুল। এই সময় মুসলিম দুনিয়া অনেকটা ঐক্যবদ্ধ ছিল। এই একতা সহ্য হয় না পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি গোষ্ঠীর, বিশেষ করে ইংরেজ আর ফরাসিদের। শুরু হয় এই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সূত্রপাত হয় ইংরেজ ও ফরাসিদের প্ররোচনায় বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহ। এমন একটি ষড়যন্ত্রের ফসল সৌদি আরবের মতো একটি চরম মৌলবাদি দেশের গোড়াপত্তন হয় ১৯৩২ সালে। এটি বিশ্বের একমাত্র দেশ যার নামকরণ একটি পরিবারের নামানুসারে, ইবনে সৌদ পরিবার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অনেকটা সাম্রাজ্য বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ওটোমানরা ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে জার্মানদের সাথে জোট বদ্ধ হয় । এই যুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হলে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তি পুরো ওসমানিয় সাম্রাজ্য দখলে নেয়। অনেকটা কামাল আতাতুর্কের প্রজ্ঞা ও কৌশলের বলে তুরস্ককে (যেখান হতে এই সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু) রক্ষা করতে সক্ষম হয় (বর্তমানে কামাল আততুর্ক তাঁর নিজ দেশে ইতিহাস ও রাজনীতি হতে নির্বাসিত)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজ আর ফরাসিরা মিলে সাবেক ওসমানিয় সাম্রাজ্যেও বিশাল ভুখ-কে নিজেদের সুবিধা মতো পিঠা ভগের মতো ভাগ করে নূতন নূতন রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। সৃষ্টি হয় ইরাক, সিরিয়া, ইউএই, বাহরাইন, জর্ডান, কুয়েত, কাতার, লিবিয়া, লেবানন, মিশর প্রভৃতি দেশ। এই অঞ্চলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সীমান্ত রেখা টানার মূল ভিত্তি ছিল তেল সম্পদের অস্তিত্ব। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই সব দেশ সৃষ্টি করার সময় কোন একটি দেশকেও তারা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সৃষ্টি করেনি। সব ক’টিকেই রাজতন্ত্র হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং বাদশাহ, শেখ ইত্যাদিকে মসনদে বসিয়ে দিয়েছিল। লিবিয়াতে একজন মেষ পালক গোত্র প্রধান ইদ্রিসকে বানানো হয় বাদশা। মিশরে ফারুখ। ইরাকে বাদশা বানানোর জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে ফায়সাল নামক একজনকে জর্ডান হতে এনে বাদশার সিংহাসনে বসানো হয়। মসনদে রাজা বাদশাহ থাকলে সম্পদের লুটপাটের সুবিধা হয়। সব শেষে এই দুটি ঔপনিবেশিক শক্তির বড় অপকর্মটি ছিল ইহুদিদের জন্য আরব ভূমিতে ইসরাইল নামক একটি পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি করা। বলা হয়েছিল এই রাষ্ট্রে ইহুদি আর আরবরা মিলে মিশে বাস করবে ও একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তুলবে। কার্যত দেখা যায় ইসরাইল নামক এই এলাকা হতে আরবরা যেন চিরদিনের জন্য বিতারিত হয় তার সব ব্যবস্থা করা । আজ ইসরাইলে আরবরা অনেকটা সম্পূর্ণ ভাবে বিতারিত ও বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু গোষ্ঠী। ধূর্ত ইংরেজ ও ফরাসিরা এটা নিশ্চিত করে এই নূতন সৃষ্ট দেশগুলো যেন সব সময় নানা বিষয়ে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকে। এতে তাদের সুবিধা বেশি, সম্পদ লুণ্ঠন সহজ হয়।
উপরের বর্ণনা পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে তাদের আমি ইতিহাসের সবক দিতে বসেছি । মোটেও না । ক’দিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তি হয় যার অর্থ একে অপরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে অনেকটা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার মতো। তাদের সাথে আগের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এখন শুধু তা আনুষ্ঠানিক হয়েছে। সপ্তাহ না ঘুরতেই ইসরাইল হতে সৌদি আরবের আকাশ সীমার উপর দিয়ে আবুধাবিতে উড়ে এলো প্লেন ভর্তি মার্কিন সিনেটর, কংগ্রেসম্যান আর ইসরাইলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সৌদি আরব ঘোষণা দিয়েছে এখন হতে ইসরাইলের জন্য তাদের আকাশ সীমা উন্মুক্ত। এর আগে ইসরাইলের নির্বাচনে নেতানিয়াহুর বিজয় নিশ্চিত করতে সৌদি আরব অর্থ ঢেলেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সৌদি আরব তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ কখনো অস্বীকার করেনি।
সৌদি আরবকে অনেক মুসলিম দুনিয়ার মুরুব্বি মনে করে। মুসলমান প্রধান দেশসমূহের সংগঠন ওআইসি’র মোট সদস্য দেশের সংখ্যা ৫৭টি যাদের মধ্যে মাত্র চারটি দেশ নিজেদের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছে। এরা হচ্ছে পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান আর মৌরিতানিয়া। পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল ওমর জাবেদ বাজওয়া ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদ কয়েক সপ্তাহ আগে গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। উদ্দেশ্য সৌদি বাদশাহকে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করা। দেখা না করে বাদশাহ বলে পাঠালেন এই সব শোনার তাঁর সময় নেই। এগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সৌদি আরবের সাথে ভারতের সম্পর্ক পাকিস্তানের চেয়ে সব সময় ভাল। হতাশ হয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি ছুটলেন চীনে। যে চীন বছর বছর ধরে তাদের উইঘুর প্রদেশে কয়েক লক্ষ মুসলমানেদর উপর চরম নির্যাতন চালাচ্ছে তারা কেন কাশ্মীর নিয়ে মাথা ঘামাবে ? উইঘুর বিষয়ে কোন মুসলিম দেশকেতো দেখা যায় না টুঁ শব্দটি করতে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চাইছে তুরস্ক, মালয়েশিয়া আর পাকিস্তানকে নিয়ে সৌদি বলয়ের বাইরে মুসলিম দুনিয়ার আর একটি মোড়ল গোষ্ঠী সৃষ্টি করতে। এখন পর্যন্ত ইমরান খান তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। মুসলিম দুনিয়ার অন্যতম পরাশক্তি ইরানের সাথে সৌদি আরব আর তুরস্কের সম্পর্ক কখনো ভাল ছিল না। সৌদিরা যে মুসলমান তা ইরান কার্যত স্বীকার করে না। ২০১৬ সালে ইরান তাদের দেশ হতে কাউকে হজ্বব্রত পালন করতে সৌদি আরব যেতে দেয়নি। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন ইরান আর জর্ডান যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে পাকিস্তানকে সকল ধরণের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। সেই ইরান ২০০৩ সালে ভারতের সাথে এক সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে যার অন্যতম ধারা হচ্ছে কোন এক তৃতীয় দেশের সাথে যুদ্ধ লাগলে একে অপরের বিমান ও সামরিক ঘাঁটি ও স্থাপনা ব্যবহার করতে পারবে। তার অর্থ দাঁড়ায় কোন সময় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হলে ভারত ইরানের কাছে এই ধারার কার্যকর বাস্তবায়ন চাইতে পারে ।
একাত্তরে যখন পাকিস্তান সেনা বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের উপর নৃশংস গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন ইরাক ছাড়া বিশ্বের অন্য কোন মুসলমান প্রধান দেশ এর সামান্যতম নিন্দাও করেনি। অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের সাথে সংহতি প্রকাশ করার জন্য বিশ্বের বৃহত্তম মুসলমান প্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ার নেভির একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর ফেলে। তাদের নৌ সেনারা চট্টগ্রাম শহরে খোলা জিপে ঘুরে বেড়ালো এটি দেখাতে ‘আমরা এসে গেছি’। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করলো বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে। সেই বাংলাদেশকে সৌদি আরব স্বীকৃতি দিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর। সৌদি আরব বর্তমানে আমেরিকার হয়ে প্রতিবেশী মুসলমান প্রধান দেশ ইয়েমেনের উপর নিয়মিত বোমা ফেলে নিরীহ মানুষ হত্যা করে। এই পর্যন্ত ওআইসি ভুক্ত কোন দেশ সে সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। ভারতের কাশ্মীর নিয়ে বাংলাদেশের কিছু মহল ছাড়া আর কারো তেমন মাথা ব্যথা নেই। মিয়ানমার তাদের এথনিক ক্লিনজিংএর অংশ হিসেবে আরাকান রাজ্য হতে রোহিঙ্গা মুসলমান উৎখাত করা শুরু করলো। রাতারাতি বাংলাদেশে দশ লক্ষ ঢুকে পড়লো। এখন তারা বংশ বৃদ্ধি করে প্রায় বার লক্ষ। কয়েক হাজার গেল মায়লেশিয়া আর থাইল্যান্ডে। কিছু ভারতে গিয়েছিল। থাকতে পারেনি। মিয়ানমারের এই অমানবিক কর্মকা- নিয়ে কোন মুসলিম দেশের তেমন কোন উচ্চবাচ্যতো শোনা যায় না। তাদের দেখতে বাংলাদেশে এলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের স্ত্রী। চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। রোহিঙ্গা শরাণার্থী শিবিরে গিয়ে কিছু ফটো শেসন হলো। তারপর সব শেষ। কিছু দিন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির হয়ে উঠলো বিদেশি মেহমানদের এক আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। মিয়ানমারের সাথে মুসলমান প্রধান দেশ ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া আসিয়ানের সদস্য। এই তিনটি দেশকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কখনো এই ফোরামে কোন উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায় না।
বর্তমান সময়ের জটিল ভূ-রাজনীতি পর্যালোচনা করলে এটি পরিষ্কার মুসলিম উম্মাহ বলতে বাস্তবে কিছু নেই। ওআইসি ভুক্ত ৫৭টি দেশ অভিন্ন কণ্ঠে কোন বিষয়ে কোন কথা বলতে পারবে না। ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বিষয়ক সমস্যার কোন সমাধান হবে না। রোহিঙ্গাদের অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে তা মনে হয় না। সকলে ঠিক করেছে নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে অন্য কারো স্বার্থ রক্ষার জন্য তেমন কিছু করা বোকামি । আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে এই সব বিষয় মনে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: বিশ্লষক ও গবেষক
মতামত উপ-সম্পাদকীয়