মার্চের যে-গর্জনে জেগেছিল বাংলাদেশ

হাফিজ রশিদ খান »

বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের রয়েছে একবারে ওতপ্রোত সম্পর্ক। আগের বছর বা মাসগুলোর নানা চমকানো, শোকাবহ ও চাপা ক্রোধের ঘটনাধারার জটটি গড়াতে-গড়াতে যেন মার্চে এসেই খুলে গেল হাট হয়ে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সেখানে ঘটালো আকাশ রাঙানো বিপুল বিস্ফোরণ। বাঙালি বুঝে গেল, এবার ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে[ তোলো’র দি এসে গেল। আর নেই পেছনে ফেরার দায়। এবার ঝড়ের গতিতে স্থবিরের স্তূপে ‘লাথি মার ভাঙরে তালা’র দিন এলো।

তখন ছিল এদেশটার নাম পূর্ব পাকিস্তান। আর যারা এদেশের সম্পদ আর সম্ভ্রম লুটছিল তাদের নিবাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। হাজার মাইল দূরের এই ভিনভাষী, এই ভিনদেশি, ভিন সংস্কৃতির শাসক নামধারীরা সেই রাষ্ট্রের গদিতে সমাসীন ছিল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনে। তাঁদের প্রতিপত্তিশালী বাহিনী আর জব্বর আমলাতন্ত্র দেখেনি এমন কা- আর কখনও যে, এদেশের মানুষেরা মানছে না তাঁদের চোখরাঙানি, তাদের বুটের দলন, তাদের বেয়নেটের খুঁচানি। মানছে না তাদের আইন, তাদের বিধিনিষেধের ডেরা। তাঁরা মানছে শুধু একটি বজ্র কণ্ঠস্বরের নির্দেশনামা : ‘সরকারি কর্মচারীরা ১ তারিখ বেতন নিয়ে আসবেন।’ অর্থাৎ চরম অসহযোগের তোলপাড়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পুরোপুরি টলে গেছে। তখন তার ডুবুডুবু দশা।

২৫ মার্চ রাত ১২টার পর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে বৃষ্টির মতো গোলাগুলি বর্ষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করলো পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা। তার আগেই বঙ্গবন্ধু টেলিগ্রাফ ও ওয়্যারলেসের মাধ্যমে পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা পৌঁছে দিয়েছেন দেশপ্রেমীদের ঘরে ঘরে, তাদের আখড়ায়। দেশ চলে গেছে তথাকথিত রাষ্ট্রচালকদের আওতার বাইরে। ফলে তারা হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিকা-, লুণ্ঠন, শিশুহত্যা ইত্যাদি বর্বরতায় মেতে উঠলো। আর শুরু হলো পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের তরুণেরা সশস্ত্র হয়ে উঠলো। তরুণীরাও তাদের পাশে দাঁড়ালো সাহসের ইন্ধনরূপে। বাংলাদেশ ওই মার্চের পথ ধরেই এগিয়ে গেছে স্বাধীনতার তোরণে। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার দুর্গ ভাঙার দুর্বার লড়াইয়ে। নিজস্ব ভূমি ও চেতনার মিনার গড়ার স্বপ্নে। এবং তা বছর শেষে ১৬ ডিসেম্বরে সূর্যোদয়ের রঙে রাঙা হয়ে এলো স্বাধীনতা হয়ে।

কাজেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, জাতীয় চেতনার পূর্ণবিকাশ ও তা প্রাণপণে পৃথিবীর বক্ষে প্রথিত করবার ইতিহাসে একাত্তরের মার্চের রয়েছে জ্বলজ্বলে অবদান। যা অগ্নিগিরির লাভা স্রোতের মতো স্থির হয়ে একটি শক্তপোক্ত রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছে। যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।