রায়হান আহমেদ তপাদার »
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আদিকাল থেকে সভ্যতার সিঁড়ি বেয়ে মানুষ তার প্রয়োজনে সামাজিকভাবে জীবন যাপনের লক্ষ্যে কিছু নিয়মনীতি শৃক্ষখলাবোধ আইন প্রথা মেনে চলে। যদিও জনগণের কল্যাণ মূলত আইনের উদ্দেশ্য তবুও সব সময় সর্বক্ষেত্রে আইন ন্যায়বিচার ও নীতির উপর অটল থাকে না। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে আইনের দৃষ্টিতে সমান এই কথাটি সকলে বললেও মূলতঃ তা পুরোপুরি সঠিক নহে। যদিও আইন কোন ব্যক্তি বা বিশেষ মোকদ্দমার জন্য প্রণীত হয় না তবুও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্হায় আইনের শাসন ও মানবাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নিজকে সভ্য করার চেষ্টা করছিল সেই আদি কাল থেকে যা এখনও নিরন্তর। মূল্যবোধের দীনতা এবং নৈতিকতার বিচ্যুতি সমাজে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনায় প্রায়শই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পরিবার ও সমাজের দায় এবং আমাদের বিপরীতমুখী যাত্রার প্রবণতা ও বাসনা। মুরারিচাঁদ কলেজের ধর্ষণকা-, ফেনীর নুসরাত হত্যা, সাব-রেজিস্ট্রারের ছেলে দিহানের লাগামহীন জীবন এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গুলশান ট্রাজেডি কিসের ইঙ্গিত বহন করছে? এ সমাজের সবাই উচ্চাভিলাষী এবং চাকচিক্যময় জীবন উপভোগ করতে চায়। যুগের পরিবর্তনে এ চাওয়াটা অমূলকও নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এসব চাওয়া কিভাবে পূরণ করবে? বিপত্তিটা সেখানটায়? সমাজের মূল্যবোধ চর্চার নিম্নগামিতার সুযোগেই নানামুখী নেতিবাচক প্রপঞ্চগুলো যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে সমাজ-সংসারে বিধঁছে। একসময় এ সমাজে সামাজিক অসঙ্গতি অস্থিরতা ও অসামাজিক ক্রিয়া-কলাপ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চোখ লজ্জার অস্তিত্ব থাকলেও বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির প্রসারে আজ এসব অতীত। এবং কারো কাছে গেঁয়ো এবং সেকেলের মানসিকতা বলে বিবেচিত হয়। আমরা যদি শৈশবের স্মৃতি হাতড়াই তাহলে কি দেখতে পাই?যে কোন দেশের উন্নয়ন কখনও টেকশই হতে পারে না যদি সে দেশের মানুষ সভ্য ও মানবিক না হয়। কোন দেশে যদি মানবতা মানবাধিকার গুম, খুন, জুলুম একক আধিপত্য, বিরোধী মতবাদকে উপেক্ষা করা হয় তখন ঐ দেশের গণতন্ত্রান্তিক পরিবেশ বিনষ্ট হয় যা কখনও কাম্য নয়। মানবাধিকার বলতে এমন কিছু অধিকারের সমষ্টিকে বুঝায় যা একজন মানুষ সমাজে বসবাস করলে স্বাভাবিক ভাবে সে যা লাভ করে সে অধিকার যা অ-হস্তান্তর যোগ্য, অক্ষয়, ও অন্তনির্হিত থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় মানবাধিকারের যে তত্ত্বসমূহ দেখা যায় তম্মধ্যে প্রকৃতিবাদী মতবাদ, প্রত্যক্ষবাদী মতবাদ ঐতিহাসিক মতবাদ ও সমাজতাত্ত্বিক মতবাদ মূলত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সমাজতাত্ত্বিক মতবাদের মূল উপজীব্য মানুষ তাই এই মতবাদ অনুযায়ী আইন প্রণয়নের পদ্ধতি হচ্ছে সমাজকে নতুনভাবে নির্মাণ করা। সমাজকে বিনির্মানে প্রতিটি জাতি গোষ্ঠির ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের যে রূপ বর্তমানে রয়েছে তা পাশ্চাত্য সভ্যতারই ফল। অন্যদিকে বিশ্বের কিছু ধনী রাষ্ট্রের নিছক স্বার্থের কারণে আজ বিশ্বমানবতা হুমকির মুখে পড়েছে।বর্তমান বিশ্বে মানবতা একটি নিছক একটি ভ-ামিতে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক সমাজ পরিবার এবং সম্প্রদায়ই তার পথ চলায় বেশকিছু অলিখিত আচার-আচরণ নৈতিক মানদ- প্রথা বিধি মূল্যবোধে আবিষ্ট হয়ে সামাজিক বন্ধন নির্ভরশীলতা বিশ্বাস নিরাপত্তা এবং অকৃত্রিম তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি পাওয়ার মানসে নিয়ত নিযুক্ত।
সামাজিক জীবের তকমায় ভূষিত মানব জাতি যারা কিনা সমাজের বিবর্তনের নানা পথ বেয়ে বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যের সুফল ভোগ করে সময়ের ধারাবাহিকতায় গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দার পরিচয়ে অজান্তেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে।এ সমাজে সুদ ঘুষ কে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। যেসব লোক এসবের সাথে সম্পৃক্ত ছিল সমাজের অন্যরা তাদের সাথে মেলামেশায় দূরত্ব বজায় রাখত। গ্রামে অনেকটা এক ঘরে বসবাস করত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আজ কি দেখছি? এসবের উৎস না খুঁজে অবলীলায় তাদের সাথে অভিযোজন ঘটিয়ে অজান্তেই সুদ ঘুষকে বৈধতা দিয়ে এসবের চর্চায় মগ্ন থাকছি। এ মানুষেরাই কিনা নামে-বেনামে দান-খয়রাত উপঢৌকন এবং সামাজিক কাজে নিজেদের জড়িয়ে হাতেম তাঈয়ের লকব গায়ে মাখছে।
যে করেই হোক নিজের বাসনা চরিতার্থ করতেই হবে। সমাজ-সংসার কি এভাবে চলতে পারে?সমাজ পরিবার সংসারে অবাধ যৌনতাকে কখনো সমর্থন দেয়নি। সব সমাজেই নানা কানুন ও অলিখিত প্রথা মূল্যবোধ ও নৈতিকতার দ্বারা এসব নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছিল। কিন্তু হালে আমরা কি দেখছি? পাশের বাড়ির বিবাহিত যুগল যার স্বামী কিনা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ সুন্দরের প্রত্যাশায় মধ্যপ্রাচ্যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে নানা স্বপ্ন বুনছে। তার প্রেয়সীই কিনা সমাজ সংসারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবলীলায় পরকীয়ায় মত্ত থেকে সংসারে অশান্তি ও অনিশ্চয়তা আমদানি করছে। সমাজ কি পারছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে? আজকাল দেখা যায় অনেকেই লিভ টুগেদার করছে। এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের তকমায় যে কেউ ইহা করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমাদের সমাজ সংস্কৃতি বিশ্বাস লোকাচার কি এসবকে অনুমোদন দেয়? তাহলে এসব কিভাবে হচ্ছে? ভাবার সময় এসেছে। ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তির আশীর্বাদের সুফল সব বয়সের শ্রেণি-পেশার মানুষেরই ভোগ করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু একবার কি ভেবেছি টিনএজারদের হাতে এসব ডিভাইস তুলে দিয়ে আগামী প্রজন্মকে বিপথগামী করছি না তো। মানুষ সারা জীবন ব্যাপী শিক্ষা লাভ করে। এমন কি মৃত্যু অবধি সে ভুল করে এবং শিখে। পারিবারিক আবহে এবং পরিম-লে শিশুরা যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সবক পায় তা পরবর্তী জীবনে চলার বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। পরিবার কি পারছে তার কাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে? ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বপ্ন বাসনা এবং ব্যস্ততার সুযোগে আমরা পারস্পরিক ভালোবাসা ও আন্তরিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। এসব ভালো লক্ষণ নয়।
নৈতিকতার বিচ্যুতি সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা রীতি নীতি নিয়ম প্রথার যথার্থ অনুশীলনের ঘাটতির সুবাধেই এসব হচ্ছে। সময় এসেছে ভেবে দেখার এবং এক্ষেত্রে পরিবারই পারে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে। যার হাত ধরেই সমাজ-সংসারে সুদিন ফিরতে পারে। পারিবারিক বন্ধন ভালোবাসা শাসন পরিচর্যা মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার মাঝেই এ দৈন্যতার অবসানের স্বপ্ন দেখা যেতে পারে। মুনাফেকি আচরণ চাটুকারিতা কারসাজি এবং দালালি প্রবণতা যেন আমাদের অস্তিত্ব এবং মজ্জায় বাসা বেঁধে ফেলেছে। যার প্রভাবে সাদাকে সাদা বলার পরিবর্তে নানা রংয়ে ভূষিত করছি। এবং অন্যরা অবলীলায় দেখেও না দেখার ভান করে প্রকারান্তরে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে। যার কারণে শিক্ষক চিকিৎসক বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক স্ব স্ব অবস্থানে থেকে সত্য বলতে পারছে না বা চায় না। এবং অনেক ক্ষেত্রে সাহস পায় না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো আইনের প্রতি বিশ্বাস হারানো। এটি ঘটলে মানুষ তখন আইন নিজের হাতে তুলে নিতে থাকে এবং সমাজে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মধ্যে আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাস অটুট রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি যেভাবে অবাধ আর সহজ করে দেয়া হয়েছে পৃথিবীর কোনো দেশে এটা নেই। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার এখানে মহামারী আকার ধারণ করেছে। বিশ্বের কোনো দেশে এত সহজে, এত সস্তায়, এত বিষয় কারো হাতের মুঠোয় নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ১৮ বছরের নিচের ছেলেমেয়েদের ফেসবুক ব্যবহারের বিষয়ে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে ঘরে ঘরে ওয়াইফাই ঢুকে গেছে আর শিশুর হাতে রয়েছে এর পাসওয়ার্ড। এসব প্রতিকারের উপায় হিসেবে রাষ্ট্রকে সবার আগে ঠিক করতে হবে আমরা আসলে কি চাই, কোথায় যেতে চাই। সেজন্য আজ দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি ঐক্যের জায়গায় আসতে হবে এবং সবাই মিলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ও পরিণতি থেকে রক্ষা করতে হবে।
সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের কাছে এখন চাহিদা পূরণই আসল বিষয়। কিভাবে পূরণ করা হলো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে মানুষ তার আকাক্সক্ষা পূরণের ক্ষেত্রে এখন সামনে কোনো বাধা এলেই হত্যাকে বেছে নিচ্ছে সহজ পথ হিসেবে। ভোগের আকাক্সা তীব্র আকার ধারণ করছে আমাদের মধ্যে। আজকে অবাধে ছড়িয়ে পড়া তথ্যপ্রযুক্তি, গণমাধ্যম নানামুখী চাহিদা এবং ভোগের আকাক্সা সৃষ্টি করছে মানুষের মধ্যে। পাশাপাশি সন্তানদের প্রতি মা-বাবার মনোযোগের অভাব, ধর্মীয় এবং নীতি- নৈতিকতা চর্চার অভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অনাচার। এছাড়া ভোগবাদিতা, অধিক পাওয়ার আকাক্ষা, সবকিছুতে তীব্র প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক অনিয়ম অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, নৈতিকতা চর্চার অভাব,সমাজে ছড়িয়ে পড়া অন্যায়-অনাচারের কম বেশি শিকার আজ সবশ্রেণীর মানুষ। ফলে মানুষ সহজেই বিবেকশূন্য হয়ে হিং¯্রতায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট