মানবপাচারকারীদের ধরতে মরিয়া আইনশৃংখলা বাহিনী

কক্সবাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »

মানবপাচারকারীদের ধরতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কক্সবাজার আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুরু করেছেন উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্নস্থানে অভিযান।

জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচারকারী চক্র প্রশাসনের নজর এড়িয়ে অত্যন্ত গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ড। এবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কড়া নজরদারীতে তারা সতর্ক হয়ে কাজ করছে। মাঝে মধ্যে সিন্ডিকেট সদস্যরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক ফোকরে তারা জেল থেকে বেরিয়ে আবারও শুরু করে মানবপাচার। মালয়েশিয়া পাচার ভিত্তিক এই সিন্ডিকেটটি পুরো উখিয়া-টেকনাফ গিলে খাচ্ছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি এ সিন্ডিকেটে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ তাদের সাথে যুক্ত হয়ে পাচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে।

সূত্রে আরো জানা গেছে, উখিয়ার উপকূলীয় ইউনিয়ন জালিয়াপালং এবং টেকনাফের উপকূলীয় ইউনিয়ন বাহারছড়া ও শাহপরীর দ্বীপকে তারা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। প্রথমে পাচারকারী দল মালয়েশিয়াগামীদের উপকূলীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে জড়ো করে। পরে সুযোগ বুঝে রাতের আঁধারে পাচারের উদ্দেশ্যে ট্রলারে তুলে রওয়ানা করে। অনেক সময় এসব পাচারকারীদল তাদের সাথে প্রতারণা করে ট্রলার নিয়ে গভীর সাগরে নিয়ে গিয়ে দু’একদিন কাল ক্ষেপণ করে আবারও একই জায়গায় অথবা উপকূলের যে কোনস্থানে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।

এদিকে সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে উখিয়া উপজেলার ভূমি অফিসের সামনে থেকে স্থানীয় মানবপাচার চক্রের ছয় সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় ভুক্তভোগী ৪৮ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উদ্ধার করা হয়। আটককৃতরা হলো, টেকনাফ পৌরসভার নতুন পল্লান পাড়া এলাকার মৃত আজিজুর রহমানের পুত্র ফজল আহমদ (৬৫), উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের হাজম রাস্তার মাথা এলাকার মো. ইউনুসের পুত্র মোহাম্মদ আলী জোহার (২৮) একই এলাকার মো. জালালের পুত্র ইমাম হোসেন (৩৫), আয়ুব আলীর পুত্র মো. আয়াজ (১৯) ও জিয়াবুল হকের পুত্র মো. জুবায়ের (২০) এবং পালংখালীর ভাদীতলী এলাকার মৃত আক্তার কামালের পুত্র মোহাম্মদ রুবেল (১৯)।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) আহমেদ সঞ্জুর মোরশেদ বলেন, মানবপাচার চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে টাকার বিনিময়ে মানবপাচার করে আসছিল। তিনি বলেন, বর্তমানে মানবপাচারের মতো ঘৃণ্যতম অপরাধ থেমে নেই। মানবপাচারকারী চক্রের টার্গেট এখন রোহিঙ্গারা। আর তাদের পাতা জালে জড়িয়ে অবৈধপথে পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে এসব মানুষ। পাচারকারীরা বিভিন্ন জায়গায় চাকরি এবং রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল এই মানুষগুলোকে ফাঁদে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। আটককৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

অপরদিকে, টেকনাফের বাহারছড়া উপকূল থেকে শুক্রবার (২৫ মার্চ) ভোররাতে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গোপসাগরের টেকনাফ উপকূল থেকে ৫৪ রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করেছে র‌্যাব। এ সময় তাদের পাচারে জড়িত দুই দালাল ও স্থানীয় একজনকে আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে নারী, পুরুষ ও শিশু রয়েছে।

কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর উপ-অধিনায়ক তানভীর হাসান জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে বাহারছড়ার শামলাপুর চ্যানেল থেকে ৫৪ রোহিঙ্গা, দুই দালাল ও স্থানীয় একজনকে আটক করা হয়। এ সময় তাদের ব্যবহৃত ট্রলারটি জব্দ করা হয়।
আটক রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘মূলত দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল আটক রোহিঙ্গাদের। খবর পেয়ে তাদের আটক করা হয়।

এছাড়াও গত ২১ মার্চ বিকালে মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে মালয়েশিয়াগামী ১৪৯ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে মহেশখালী থানা পুলিশ। উদ্ধার হওয়া এসব রোহিঙ্গারা দালালের সহযোগিতায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ট্রলারে করে সাগরপথে রওয়ানা দেয়। দালাল চক্রের প্রলোভনে পড়ে জনপ্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে স্বপ্নের মালয়েশিয়া যেতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা ট্রলারে উঠেছিলো। কিন্তু সাগরে কোস্টগার্ড ও নৌ বাহিনীর কড়াকড়িতে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ট্রলারটি যেতে পারেনি। প্রায় এক সপ্তাহ’র চেষ্টাতেও সম্ভব না হওয়ায় টাকা ‘হজম’ করতে মালয়েশিয়া পৌঁছেছে বলে নারী, শিশুসহ ১৪৯ জন রোহিঙ্গাকে সোনাদিয়ার চরে নামিয়ে দিয়ে দালাল চক্র ট্রলার নিয়ে পালিয়ে যায়। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গার মধ্যে ৭৫ জন নারী, ৫১ জন পুরুষ ও ২৩ জন শিশু রয়েছে। পরে উদ্ধার হওয়া এসব রোহিঙ্গাদের ২২ মার্চ ভোরে ৩টি বাসে করে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম বোটক্লাবে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ভাসানচরে পাঠানো হয়।

টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন বলেন, পাচারকারীদের ধরতে প্রশাসনকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি। এবং তারা ধরাও পড়ছে। তারা যেন সহজে জেল থেকে ছাড়া না পায়, প্রশাসনকে সেদিকে নজর দিতে হবে বেশি।
উখিয়া উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন পাচার প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে। আইনশৃংখলাবাহিনী ঘন ঘন অভিযান পরিচালনা করলে পাচারকারীরা পালিয়েও রক্ষা পাবে না।