আবু সাঈদ »
‘মানুষ সমাজবদ্ধ জীব’। সমাজ ক্রমপরিবর্তনশীল হলেও এ সত্য অনস্বীকার্য। তবে পূর্বের সহজ-সরল ও গোষ্ঠীবদ্ধজীবন থেকে এ সমাজ জটিলরূপ ধারণ করেছে। মানবসমাজের এ পরিবর্তন বা বিবর্তন বিভিন্ন জটিল ও কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়ে চলেছে। সামাজিক বিবর্তনের এ ইতিহাসে মানুষ যেমন সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তেমনি আবার ওল্টোটাও ঘটতে দেখা গেছে। অর্থাৎ ব্যক্তিই সমাজকে প্রভাবিত করে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। তবে সামাজিক সচলতার জন্য ব্যক্তি ও সমাজÑ উভয়কে সক্রিয় থাকতে হয়। শিল্পসাহিত্য যেহেতু সমাজ দ্বারা প্রভাবিত, তাই সমাজ পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়ায় সাহিত্যও আঙ্গিক পরিবর্তন করে। অবশ্য এ পরিবর্তনে শিল্পীর মনোভঙ্গি এবং তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতাও সমানভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতা দেশকালপাত্ররহিত। এ দায়বদ্ধতার সীমা এবং সীমানা মানে না। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি এ সম্পর্কে স্মতর্ব্যÑ যেখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন-লুণ্ঠন, সর্বোপরি, যেকোন ধরনের আগ্রাসনকে প্রচ- ধিক্কার জানিয়েছেন। মহীবুল আজিজ-এর ‘প্রাতঃরাশ’ কবিতাটি কবির এ দায়বদ্ধতার প্রামাণ্যদলিল। যেখানে কবিকে দেখা যাচ্ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে। এ একাত্মতা কবিকে সর্বকালের এবং সর্বমানবের বিবেকী কণ্ঠস্বরে পরিণত করেছে।
‘প্রভাতের প্রথম খবরে টেলিভিশনের পর্দায় সোমালিয়ার
ক্ষুধার্ত মানবসন্তানদের দেখে ক্ষুধা হয়ে উঠল সর্বগ্রাসী।
মনটা এত খারাপ হয়ে গেল যে কেউ আর ফ্রিজবন্দি
ইয়র্কশায়ার পুডিংয়ের ইচ্ছেই করলো না। আর কালো
আফ্রিকার মরণক্ষুধা দেখে পনিরের ঘাটতিটুকুও কেউ গায়ে
মাখলো না।’ (প্রাতঃরাশ)
এ মানবিক সত্য উচ্চারণে কবির মধ্যে কোনো ধররের ইতস্ততার বোধ নেই। কবি আবেগকে সংযত রেখে বাস্তবতাকে প্রখর এবং প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। এবং এ বাস্তবতার সঙ্গে কবি নিজেকেও সংযুক্ত রেখেছেন। সমাজের সঙ্গে কবির এই একাত্মতা পরবর্তীকালে তা আরো দৃঢ় ও সংহত হয়েছে। এর ফলে কবির কণ্ঠস্বর মিলিত হয়েছে সামষ্টিক কণ্ঠস্বরে। এজন্য তাঁর কবিতা কোনো দূরজগতের বিষয় হয়নি, হয়েছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ও জগত-সংলগ্ন। ‘আমিত্বের’ অহংবোধ থেকে মুক্ত হয়ে কবিকে দেখা যায় সামষ্টিক এবং যৌথজীবনের সঙ্গে একাত্ম হতে। এজন্য জনতার মিতালি তাঁর কাছে ‘জঘন্য’ মনে হয়নি বরং তিনি আস্থা রাখছেন জনতার সম্মিলিত মিতালিতেই। এমনকি কবি শেষ আশ্রয়ও খুঁজে নিচ্ছেন এ জনতার মধ্যেই।
‘মানুষ নামক এই সীমানার ভেতরেই আমি থাকতে চাই।
এলাকাটা ছোট মনে হলে তোমরা বেরিয়ে যেতে পারো স্বেচ্ছায়,
এর সঙ্গে চাইলে যোগ করতে পারো আরও বাড়তি কিছু।
আর একটি অতিরিক্ত বর্ণ দূরে থাক এর কোনো
প্রতিশব্দেরও দরকার নেই আমার।
আমি এ চারদিকে সীমানা দেয়াল তুলে
ম-এর শরীরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি
সারাক্ষণ, অথবা ন-এর নিচে
কু-লী পাকিয়ে শুয়ে থাকতে পারি বিড়ালের মতো।
তারপর ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্ন দেখে, ফের জেগে
উঠতে পারি আবারও ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে।
আমার আর কোথাও যাবার দরকার নেই।’
(মানুষ নামক এই)
মহীবুল আজিজ-এর কবিতায় ব্যক্তিমানুষের সমাজ-নিরপেক্ষ কোনো সত্তা নেই, বরং সমাজ এবং ব্যক্তিÑ উভয়ই একই বিন্দুতে লীন হয়ে আছে তাঁর কাব্যশরীরে। এ ধরনের সংশ্লিষ্টতার কারণেই তাঁর কবিতা স্বতন্ত্র মর্যাদায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। সমাজভাবনা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণেই তাঁর কবিতায় বিদ্রোহের সুরধ্বনিত হয়েছে। তবে এ ধ্বনি উচ্চকণ্ঠের নয়, সংহত এবং তাৎপর্যম-িত। এই সুরে সমাজচেতনা এবং স্বাদেশিকতা একাকার হয়ে আছে। যেকোনো অত্যাচার-নিপীড়নকে তিনি প্রতিরোধ করতে চান বিচ্ছিন্নভাবে নয়; সম্মিলিতভাবে। আর সংলগ্ন হয়ে থাকতে চান শেকড়ের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে।
‘তাই মুক্তি চাই বিষমাকড় থেকে
এসো বন্ধুরা মিলি এ-প্রান্তরে আজ।
পরে নিই অভিনব রিচ্যুয়াল-সাজ
নাচবো খুব চতুর্দিকে বৃত্তকে রেখে।’
(ট্যারানটেলা)
মহীবুল আজিজ-এর এ শেকড়সংলগ্নতা তাঁর কবিতাকে শক্তিশালী এবং বাক্সময় করে তুলেছে। দেশ ও কালসচেতনতা এবং দায়বোধ তাঁর কবিতাকে জীবনধর্মী এবং কেন্দ্রমুখী করেছে। তাঁর কবিতায় চলমান সময় ও সামাজিক চিত্র যেমন প্রতিফলিত হয়েছে তেমনি এর ব্যাপ্তিও প্রাচীন সভ্যতা থেকে বহমান সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর কবিতা পাউন্ড-এর মতো ‘লুপ্ত সময়’কে উদ্ধারে সচেতন থেকেছে এবং জয়েস-এর মতো তাঁর কবিতা বহমান সময়কে ধারণ করেছে। এ দুটো এখানে বিপরীত হয়ে আসেনি, এসেছে সহযোগী হয়ে। হাত ধরাধরি করে তারা চলেছে সামনের দিকে। এ চলায় তিনি ক্লান্তিহীন এবং লক্ষ্যাভিমুখী। এখানে তিনি সংবেদনশীল থেকেছেন, আবেগকে সংযত এবং নিজেকে সংহত রেখেছেন। ইতিহাসকে তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ অবস্থানে দাঁড়িয়ে। এ চলায় তিনি অনেক বিষয়ের ওপর আলো ফেলে-ফেলে এগুচ্ছেন। এ দীর্ঘ সময় ধরে এ দীর্ঘপথ পরিভ্রমণে তিনি যন্ত্রণা, পরিবর্তন, প্রেম, বিরহ, বিষাদ প্রভৃতি স্পর্শ করছেন। ফলে তাঁর কবিতার উপযোগ সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায়ও। তবে এ দীর্ঘ পরিভ্রমণে তাঁর মধ্যে সর্বদা কেন্দ্রাভিমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তাঁর কবিতা অস্থিরতাবর্জিত, কারণ তিনি জানেন, অস্থিরতার কারণে সম্মিলিত হওয়ার পরও মানুষ নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছুতে পারে না। অস্থিরতা এবং তাড়াহুড়ো লক্ষ অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে :
‘দেয়ালটা সরাবো বলে বারবার আমরা জড়ো হই দেয়ালের কাছে,
আশায় টগবগ ফুটে বলি, আমরা সরাবোই দেয়ালটা !
দেখতে-দেখতে ময়লা শ্যাওলা জমে দেয়ালের গায়ে,
আমরা জড়ো হয়ে বলি, দেয়ালটা সরাবো কিন্তু
তার আগে শ্যাওলাটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন;
শ্যাওলা আমরা করবোই পরিষ্কার!
……….
আমরা সমস্বরে বলি, দেয়ালটা সরাবো কিন্তু
তার আগে সাপ, ঘাস এবং শ্যাওলা দূর করা দরকার!
সবার আগে সাপগুলো মেরে ফেলা দরকার!
তখন সাপেরা ফোঁস করে ওঠে এক জোটে,
এবং আমরা দেয়াল ছেড়ে
এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ি সভয়ে;
যে যেদিক পারি।
(একটি শিশুতোষ কবিতা)
কিন্তু এ ভয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ভয় জয় করার গল্প তিনি শুনিয়েছেন। শুনিয়েছেন সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে মুক্তির যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তার কথা। তিনি জানেন ঐক্যবদ্ধ শক্তিই পারে যেকোনো বাধাকে অতিক্রম করতে।
সম্মিলিত হওয়া চাই এবং বৃত্তে,
সংহত ও পরিস্থিত কেন্দ্রাভিমুখে।
মন্ত্রপূত অভিলাষ মুখে ও বুকে
ব্যক্ত হবে সারাদেহ মুক্তির নৃত্যে
(ট্যারানটেলা, ট্যারানটেলা)
মধ্যবিত্ত সমাজের ওপর যেসব নেতিবাচকতা ভর করে তার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে, সেসব বাধা-প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের জন্য, যেকোনো ধরনের আগ্রাসন প্রতিহতের করার জন্য কবি আস্থা রাখেন বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্তর্নিহিত এবং অন্তহীন শক্তির ওপর। এ শক্তির ওপর ভর করে কবি তাঁর যাত্রা অটুট এবং চলমান রাখেন এবং এ যাত্রা সবসময় কেন্দ্রের দিকেই ধাবিত।