নিজস্ব প্রতিবেদক »
ছোট ছোট ভূমিকম্পকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের পূর্বাভাস বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সেই ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। গত কয়েক বছরের গভীর পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার ভিত্তিতে তারা এ তথ্য তুলে ধরছেন।
গতকাল শনিবার সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ইউরোপীয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমএসসি) ও মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য মতে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল কুমিল্লা থেকে ৪৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থেকে ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। ভূপৃষ্ঠ থেকে এর গভীরতা ছিল মাত্র ১০ কিলোমিটার এবং রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। তবে জার্মান রিসার্চ সেন্টার ফর জিওসায়েন্সেস বলেছে, রিখটার স্কেলে এর মাত্র ছিল ৫ দশমিক ৮।
চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, টাঙ্গাইল, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ফেনী, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, কুষ্টিয়াতেও এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
গতকালের ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আগে গত ২ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিটে ঢাকায় মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের মেঘালয়ের রেসুবেলপাড়া থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এ সময় বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও নেপাল, ভুটান এবং চীনেও অনুভূত হয়েছে এ কম্পন।
এছাড়া গত ১৭ সেপ্টেম্বর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল চার দশমিক ২। ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল টাঙ্গাইল।
সব মিলে দেশে চলতি বছরে ১১টি হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। এতে জানমালের তেমন ক্ষতি না হলেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের আভাস মিলছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (চুয়েট) অধীন ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সূত্রে জানা গেছে, ভূমিকম্পের ফল্ট বা চ্যুতিরেখায় রয়েছে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চল। ফলে এই অঞ্চলে প্রায়ই ছোট ছোট ভূমিকম্প হচ্ছে। এসব ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের আভাস। যা ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আশংকা বহন করছে।
জানা যায়, তিনটি ফল্ট বা চ্যুতিরেখা দেশের বড় তিনটি শহরের ওপর অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এর মধ্যে শিলং মালভূমির দক্ষিণ পাদদেশে ৩০০ কিলোমিটার পূর্ব-পশ্চিম চ্যুতিরেখা এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল বরাবর সীতাকু–টেকনাফ ফল্টে প্রচুর পরিমাণ যে স্থিতিস্থাপক শক্তি জমা আছে সেটিই দেশের ভূমিকম্পের প্রধান উৎস। দীর্ঘ সময় ধরে এ শক্তি জমা থাকায় হঠাৎ করে রিখটার স্কেলে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ভূতত্ত্ববিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘এটা যে কোনো সময় এটা হতে পারে। আগামী ১০ বছরে হতে পারে আবার ৫০ বছরের মধ্যেও হতে পারে। আমরা শুধু জানি, এই সঞ্চিত শক্তি এক সময়ে বের হবেই- এর কোনো বিকল্প নাই।’
ভূমিকম্প ও ফল্ট লাইন
ভূতত্ত্ববিদ ও বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি হয়েছে, যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এ রকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যটিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূত্বকের মধ্যে ইলাস্টিক এনার্জির শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণক্ষমতা পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূপৃষ্ঠে কম্পন তৈরি হয়। আর সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।’ যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন।
ভূমিকম্পের ঝুঁকির কারণ
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবানসহ বেশ কয়েকটি শহর ও শহরতলীতে নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কেটে অথবা পুকুর-দীঘি ভরাটের মাধ্যমে বাড়িঘর ও ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া, পুরনো জরাজীর্ণ বাড়িঘর, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ, নিম্নমানের উপকরণে বহুতল ভবন নির্মাণও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। অথচ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড-১৯৯৩) অনুসরণ করে ভূমিকম্প প্রতিরোধী নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণ করলে এসব ভবন ঝুঁকির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার নিশ্চয়তা মিলতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এতে ভবন নির্মাণে খরচ মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করেন তারা।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, মান্ধাতা আমলের প্রযুক্তি দিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিস। উঁচুভবন বা সাধারণ বড় অগ্নিকা-ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো কোনো যন্ত্রপাতি নেই ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের। ফলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করা কঠিন হবে।
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি
জানা গেছে, ভূমিকম্প যদি ৭ থেকে ৮ মাত্রায় হয় তাহলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের প্রায় দেড় লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। ঘটতে পারে ব্যাপক প্রাণহানি। প্রায় ১০ বছর আগে আর্থকোয়াক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় বলা হয়, চট্টগ্রাম মহানগরীর ১ লাখ ৮৪ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৭৪০টি স্কুল।
ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ক সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীর সংলগ্ন অধিকাংশ বৃহদাকার স্থাপনা গড়ে উঠেছে বেলে মাটির ওপর, যেখানে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। ভূমিকম্পের সময় সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। কোনো পেট্রোকেমিক্যাল স্থাপনায় আগুন লাগলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। নগরীর বিভিন্ন অপ্রশস্ত সড়কের দুপাশে গড়ে ওঠা অনেক ভবনে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলা করাও কঠিন কাজ।
এখানে সংঘটিত ভূমিকম্পে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে ভূমিধস ঘটতে পারে। আর সাগরতলের ভূমিধসে সুনামি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভূমিকম্প মোকাবিলায় করণীয়
ভূমিকম্পের ভয়াবহতা এবং তা মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও চুয়েটের (চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা ইতিপূর্বে গবেষণার ভিত্তিতে বলেছি, বাংলাদেশের পাঁচটি জায়গা থেকে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে তিনটি হচ্ছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত আর দুটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। সিলেটের ডাকি ফল্ট থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে। আরেকটা হচ্ছে ময়মনসিংহ-মধুপর ফল্ট। এসব জায়গা থেকে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। আর প্রতিটি শহরে ৬ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প হবে। ২০০৮ সাল থেকে আমরা এ তথ্য জানিয়ে আসছিলাম।’
এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যাগ মোকাবিলায় করণীয় বিষয়ে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও বর্তমানে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (রুয়েট) উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ভবিষ্যতে যে বিল্ডিংগুলো হবে সেগুলো ন্যাশানাল বিল্ডিং কোড মোতাবেক ডিজাইন করতে হবে এবং কনস্ট্রাকশন করতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব উন্নয়ন সংস্থা আছে যেমন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এ সমস্ত জায়গায় যখন বিল্ডিং প্ল্যান পাশ করাতে যাবে ভবন মালিকেরা তখন ডিজাইনগুলো সঠিকভাবে হয়েছে কিনা এবং দরকার হলে সেগুলো প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর মাধ্যমে ভ্যাটিং করিয়ে নিতে হবে। আবার বর্তমানে যেসব বিল্ডিং রয়েছে সেগুলোর সুরক্ষার জন্যে অ্যাসেসমেন্ট করে শক্তি বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ কাজগুলো করার দায়িত্ব সরকারি বিল্ডিংগুলোর ক্ষেত্রে সরকারিভাবে, করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকলে সংশ্লিষ্ট করপোরেশন এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভবন মালিকের ওপর বর্তাবে। অ্যাসেসমেন্ট করার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে সহজ ভাষায় লেখা চারটা ম্যানুয়েল করে দেওয়া হয়েছে। প্রফেসর জামিলুর রেজা স্যার মারা যাওয়ার পরে আমি এ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। এগুলো বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, কলেজে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সংশ্লিষ্টদের বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটি এখনো সঠিকভাবে শুরু হয়নি। সেটা দ্রুত করতে হবে। এটি যদি হয়ে যায় তখন প্রতিটি মানুষ ভূমিকম্পে তার ভবনটি কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে তা অ্যাসেসমেন্ট করতে পারবে। এক্ষেত্রে হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ম্যানুয়েলগুলো সম্পর্কে প্রকৌশলীদের সুস্পষ্ট ধারণা দিতে রাজউক, সিডিএ’র মতো সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান এ ধরনের উদ্যোগ নিলে সেখানে পরামর্শক, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতিদের মতামতের ভিত্তিতে পুরোনো ভবনগুলো, যেমন, শিল্পকারখানা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার জন্যে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে, তা না হলে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি লাখ লাখ লোকের জীবনহানির শংকা থেকে যাবে।’
দুর্যোগ-পরবর্তী সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিটি শহরে ফায়ার সার্ভিসসহ বিদ্যমান ২৭টি সেবা প্রতিষ্ঠানকে তাদের দুর্যোগ মোকাবিলার সামর্থ্য কতটুকু রয়েছে, আরো কি কি সংযোজন করা দরকার, সেদিকেও নজর দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন ড. জাহাঙ্গীর আলম।