বিবিসি »
ভারত সরকার সোমবার (১১ মার্চ) সন্ধ্যায় ঘোষণা করেছে যে এদিন থেকেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হতে চলেছে। ২০১৯ সালে এটি পাশ করা হলেও এতদিন আইনটির ধারা বা রুল তৈরি হয়নি। এখন সে কাজ সম্পন্ন করে আইনটি বলবৎ করছে সরকার।
এই প্রথমবার ভারতের নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর ধর্মীয় পরিচয় দিতে হবে।
দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক্স-এ (সাবেক টুইটার) জানিয়েছেন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-র ধারা বা রুলগুলির আনুষ্ঠানিক নাম নাগরিকত্ব (সংশোধিত) ধারা, ২০২৪। এই ধারা অনুযায়ী ভারতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যাবে সম্পূর্ণ অনলাইন মাধ্যমে।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে সেদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, পার্শি, শিখ, জৈন ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা যদি ২০১৪ সালের ৩১শের ডিসেম্বরের আগে ভারতে চলে এসে থাকেন তাহলে তারা ভারতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
এতদিন বলা হচ্ছিল যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর আফগানিস্তান থেকে ‘ধর্মীয় সহিংসতা’র শিকার হয়ে ভারতে যদি হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পার্শি, জৈন এবং শিখরা ভারতে এসে থাকেন, তাহলেই তারা এই আইন অনুযায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন।
তবে সোমবার জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে ওই তিনটি দেশে ‘ধর্মীয় সহিংসতা’র বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।
নতুন আইনে মুসলমানদের কথা নেই।
আইনটি পাশ হওয়ার আগে-পরে ভারতজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল। দিল্লি, কলকাতা, আসামসহ দেশের বিভিন্ন শহরের সেইসব বিক্ষোভে মারা গিয়েছিলেন প্রায় একশো মানুষ।
নাগরিক সংগঠন, বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, মুসলিম সংগঠন ওই সব বিক্ষোভে শামিল হয়েছিল।
সব শহরেই সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভে উল্লেখজনকভাবে অংশ নিয়েছিলেন নারীরা। এমন বহু মানুষকেও দেখা গিয়েছিল ওই আন্দোলনে, যারা চিরাচরিতভাবে পর্দানশিন এবং তার আগে কখনও কোনও আন্দোলনেই পথে নামেননি।
ভারতের মুসলমানদের একটা বড় অংশের আশঙ্কা যে প্রথমে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সেইসব দেশের সংখ্যালঘু মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, আর তার পরে মুসলমানদের চিহ্নিত করে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি হালনাগাদ করার নাম করে নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হতে পারে।
তবে বিজেপি বারবারই বলেছে যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না।
আইন পাশের পরে চার বছর
সংসদের দুটি কক্ষে কোনও আইন পাশ হওয়ার পরে ছয় মাসের মধ্যে সেই আইনের রুল বা ধারা তৈরি করে নোটিফিকেশন জারি করতে হয়। এক্ষেত্রে আইন পাশ হওয়ার পরে চার বছর ধরে বার বার সরকার পক্ষ রুল জারি করার সময়সীমা বাড়িয়ে নিয়েছে।
তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহসহ বিজেপি নেতারা বলে এসেছেন যে সিএএ চালু তারা করবেনই।
কলকাতায় কয়েক মাস আগে এক সভায় সিএএ চালু করার কথা আবারও ঘোষণা করে গিয়েছিলেন মি. শাহ।
এখন লোকসভার নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার কয়েকদিন আগেই সরকার ওই আইনটি চালু করার ঘোষণা দিলো।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সোমবার সিএএ চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এরকম খবর চাউর হওয়ার পরেই বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গে তিনি সিএএ চালু করতে দেবেন না।
ভোটের আগেই কেন?
মমতা ব্যানার্জী এ প্রশ্নও তুলেছেন যে আইনটি যদি চালু করতেই হতো তাহলে লোকসভা ভোটের আগেই কেন?
তার কথায়, ‘‘সাহস থাকলে আগে করতেন। লোকসভা ভোটের আগেই করতে হলো কেন?’’
একই প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশও।
তিনি নিজের এক্স হ্যাণ্ডেলে লিখেছেন, “রুল জারি করার জন্য নয়বার বাড়তি সময় নিয়ে ঠিক ভোটের আগে এমন একটা সময় আইন চালু করা হল, তাতে এটা স্পষ্ট যে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ আর আসামে ভোটে মেরুকরণ ঘটানোর প্রচেষ্টা হচ্ছে।’’
অমিত শাহসহ বিজেপি নেতারা বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছিলেন যে ভোটের আগেই সিএএ চালু হয়ে যাবে, তবে গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গের এমন দুটি এলাকায় জনসভা করেছেন, যেটি মতুয়া (পূর্ব বঙ্গ এবং বাংলাদেশ থেকে আগত নমঃশূদ্র গোষ্ঠীর মানুষ) অধ্যুষিত অঞ্চল। তবে ওই দুটি জনসভায় মি. মোদী সিএএ চালু করার ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া, উদ্বাস্তু এবং সিএএ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন সিএএ চালু হলে সারা দেশেই হিন্দু ভোটের বাড়তি মেরুকরণ হবে বিজেপি-র পক্ষে। সেজন্যই হিসাব কষেই লোকসভা ভোটের আগে আইনটি চালু করা হচ্ছে।
তবে পশ্চিমবঙ্গে এই আইনটির বাড়তি রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে।
‘নমঃশূদ্র’ বা ‘মতুয়া’ সম্প্রদায় এবং উদ্বাস্তু সমাজের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ‘ভোট-ব্যাঙ্ক’।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই মতুয়ারা তাদের ধর্মগুরুর সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসেন। তারা মূলত নমঃশূদ্র গোষ্ঠী এবং তাদের মূল তীর্থক্ষেত্র বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতে।
মতুয়া সম্প্রদায় এবং তাদের ধর্মগুরুরা স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। এক সময়ের সঙ্ঘাধিপতি প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর ছিলেন কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য। তার ছেলে, পুত্রবধূ এবং নাতিরাও সক্রিয় রাজনীতিতে রয়েছেন।
একটা সময়ে এই মতুয়ারা বামফ্রন্টের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে তারা ঝুঁকতে শুরু করেন।
উদ্বাস্তু এবং মতুয়ারা পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ৩০টি বিধানসভা আসনে নির্ণায়ক শক্তি এবং দুটি লোকসভা কেন্দ্রেও তাদেরই ভোটে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়।
উদ্বাস্তু নেতাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় দুই কোটি মানুষের এখনও নাগরিকত্ব নেই।
যদিও এটাও তারা স্বীকার করেন যে আইন সম্মত উপায়ে নাগরিকত্বের নথি না থাকলেও এদের সকলেই কোনো না কোনোভাবে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ডের মতো নথি ‘যোগাড়’ করে নিয়েছেন।
তাই তারা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নতুন করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন আর করবেন না বলেই মনে করছেন উদ্বাস্তু এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের একাংশ।
সিএএ-কে কেন্দ্র করেই মতুয়াদের মধ্যে স্পষ্ট দুটি বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে।
সিএএ কি নাগরিকত্ব নিশ্চিত করবে?
মতুয়াদের একটা অংশ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে, অন্য অংশটি রয়েছে বিজেপির দিকে।
বিজেপি সমর্থক মতুয়াদের প্রধান শান্তনু ঠাকুর এখন ওই দলের সংসদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
এই অংশটি সব সময়েই চায় যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু হলে তারা নাগরিকত্বের অধিকার পাবেন।
বিজেপি সমর্থক মতুয়াদের এই অংশের বহু মানুষ সিএএ চালু কেন হচ্ছে না, এই প্রশ্ন তুলে দীর্ঘদিন ধরেই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মি. ঠাকুর নিজেও একাধিকবার এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলেরই শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।
আবার বাঙালি উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতা ও লেখক সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস কিছুদিন আগে বলেছিলেন, “আমরা বারবার বলে আসছি যে সিএএ দিয়ে কেউ নাগরিকত্ব পাবে না। এই আইন কার্যকর করা হলে আবেদন হয়তো করতে পারবেন অনেক উদ্বাস্তু এবং মতুয়ারা, কিন্তু নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার আইন এটা নয়।”
“আবার ওই আবেদনকারী যে দেশের বাসিন্দা ছিলেন, সেখানকার নাগরিকত্বেরও প্রমাণ লাগবে। অন্য দেশ থেকে এসে এখানে নানাভাবে ভারতীয় নথি যোগাড় করে যারা আজ চাকরিবাকরি করছেন, তারা কি পুরনো দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার সাহস