রুশো মাহমুদ »
আধুনিক ও মানসম্মত শহর হতে বড় বাধা ‘নিকৃষ্ট’ গণপরিবহন এবং অসহনীয় যানজট। আমাদের গণপরিবহনের এমনই বেহাল দশা যে একে নিকৃষ্ট বলা ছাড়া আর কোন যুৎসই শব্দ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। টেকসই নগরী হিসেবে পরিচিতি পেতে যানজট বড় বাধা। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে যানজট সমস্যা সমাধানে সরকার বা স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনাগুলো ধীরগতির এবং বাস্তবায়ন আরও তীব্রতর ধীর।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যানজটে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে প্রতিদিন ১৭ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যানজটের কারণে এক লাখ শ্রমঘণ্টার জন্য বছরে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক একহাজার কোটি টাকা। তার মানে চট্টগ্রামে বছরে অন্তত ১৭ হাজার কোটি টাকা যানজটে নষ্ট হচ্ছে।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এখানে। প্রতিদিনই বন্দরের পণ্য পরিবহনের যানবাহন শহরটির সড়কে বাড়তি চাপ তৈরি করে। যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ এটি। বিশেষ করে বন্দর ও এর আশপাশের এলাকার যানবাহনগুলোকে যানজটের কারণে দীর্ঘ সময় রাস্তায় বসে থাকতে হয়। সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর ও এর আশপাশ এলাকার যানজটের কারণে যে ক্ষতি হয় তার আর্থিক মূল্য বছরে ১০০ কোটি টাকারও বেশি।
যাতায়াতে বিলম্বের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়, পাশাপাশি অনেকসময় যানজটে আটকে থেকে শিল্পের অনেক কাঁচামাল নষ্টও হয়ে যায়। এতে উৎপাদক, গাড়িচালক ও যাত্রীদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। একইভাবে ব্যবসায়ীদের পরিচালন ব্যয়ও বাড়ে।
বর্তমানে চট্টগ্রামে গড় যানবাহন গতিবেগ ঘণ্টায় পনের-ষোল কিলোমিটারের কম। তীব্র যানজটের সময় গাড়ির আগে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও নগরবাসীর রয়েছে। পরিচালনার অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাই অসহনীয় যানজট তৈরি হওয়ার প্রধানতম কারণ। পাশাপাশি বাজে গণপরিবহনতো আছেই।
নগরীর কাছের উপজেলা বা পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে কমিউটার ট্রেন, মেট্রো কিংবা গণপরিবহনে কর্মের জায়গায় এনে দিনশেষে নিজ নিজ আবাসে ফিরে যাওয়ার উপযোগী পরিবহন, সড়ক ও রেলনেটওয়ার্ক নির্মাণ এখনো আমাদের উন্নয়ন দর্শনে স্থান পায়নি।
দীর্ঘ অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার ফল হচ্ছে, যানজটে নিত্যদিন মানুষের ভোগান্তি। যানজটের আরেক কারণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই শহর। বিশ্বের যেসব শহর টেকসই উন্নয়ন পেয়েছে, সেখানে গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিয়ে শহরটি গড়া হয়েছে।
ব্যক্তিগত গাড়ি ও সিএনজি অটোরিকশায় যারা চলাচল করেন, তারাও যেন গণপরিবহন ব্যবহারে আগ্রহী হন, সেই ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ আমাদের জমি কম, জনসংখ্যা বেশি।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, রাস্তার স্বল্পতা, ব্যক্তিগত গাড়িবৃদ্ধি, ফুটপাত ও রাস্তা দখল, গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়হীনতা-এসব মিলে এই যানজট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, বাড়েনি বাসের সংখ্যা। যানজটের সঙ্গে পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ঘাটতিসহ নানা বিষয় জড়িত।
রাস্তায় অত্যধিক রিকশা চলাচলও যানজটের অন্যতম কারণ। রাস্তা বা ফুটপাতে অবৈধ দখলের কারণেও কোথাও কোথাও যানজট হয়।
বেশির ভাগ শহরেই ফুটপাতে হাঁটা এক অনাবিল আনন্দের ব্যাপার। যেখানেই মানুষ বেশি, সেখানেই ফুটপাত চওড়া। আমাদের এখানে ঠিক উল্টো। পথে যাদের হাঁটতে হয় তাদের ফুটপাত এড়িয়েই চলতে হয়। দখলের যে সংস্কৃতি তার সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভবত ফুটপাত।
রিকশার বিকল্প হিসেবে কমিউনিটিভিত্তিক সেবা চালু করতে হবে। মিনিবাস, উন্নতমানের লেগুনা এর বিকল্প হতে পারে। এগুলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট এলাকায় ছোট রাস্তায় চক্রাকারে চলবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য নিজস্ব বাস চালু করে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। স্কুল শুরু ও ছুটির সময় শহরের সড়কগুলো দখল করে রাখা ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা যদি অর্ধেকেও নামিয়ে আনা যায়, তবে নিশ্চিতভাবেই এই শহরে যানজট পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি ঘটবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসহায়ের মতো বসে থাকা লাগবে না।
ফ্লাইওভার বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা ভবিষ্যতের মেট্রোর ওপর ভরসা না করে মূল সড়ক ও কমিউনিটিভিত্তিক সড়ক ব্যবস্থাপনার প্রতি জোর দিতে হবে, তবেই সমাধান সম্ভব। মূলসড়কে উন্নত বড় বাস সার্ভিস চালু করতে না পারলে এর সমাধান হবে না।
ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য স্বল্পসুদে ব্যাংকঋণ ও প্রকল্পের নামে গাড়ি দেওয়া, এসব নিরুৎসাহিত করতে হবে। নামমাত্র সুদে শহরে শ’পাঁচেক মানসম্মত বাস নামাতে পারলে ট্রাফিক সমস্যার কার্যকর সমাধান হতো। এর জন্য কয়েকটি কোম্পানির অধীনে রুটভিত্তিক ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বাসরুট রেশনালাইজেশন সমগ্র শহরে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি পদচারীবান্ধব নগর তৈরির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
যে উন্নয়ন দৃশ্যমান কিন্তু টেকসই নয়, তা উন্নয়নই নয়। বরং উন্নয়নের নামে অর্থের অপচয় এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি বোঝা। বড় প্রকল্প না নিয়ে, ব্যয়সাশ্রয়ী প্রকল্পের মাধ্যমে এই শহরের সমস্যা সামাধানের পথ খুঁজতে হবে।