সুপ্রভাত ডেস্ক »
সারা দেশের মতো তীব্র গরমে নাভিশ্বাস উঠছে চট্টগ্রামবাসীরও। তবে ঈদ যেহেতু চলেই আসছে, বসে থাকার তো জো নেই। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই ছুটছেন মার্কেট-বিপণিবিতানে। কিনছেন নিজের এবং প্রিয়জনের ঈদের পোশাক। বিপণিবিতানের পাশাপাশি কেনাকাটার ধুম পড়েছে বন্দর নগরীর ফুটপাতগুলোতেও।
রমজান মাসের আজ ২৬ তারিখ। ঈদের বাকি আর মাত্র ৩ থেকে ৪ দিন। শেষদিকে এসে ঈদের কেনাকাটায় দারুণ জমে উঠেছে চট্টগ্রামের শপিং মলগুলো। কাপড় আর জুতার দোকানের পাশাপাশি গৃহস্থালি পণ্যের দোকানগুলোতেও চলছে জমজমাট বিকিকিনি। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকছে বাণিজ্যিক এ নগরীর অধিকাংশ দোকানপাট।
আগে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিপণিবিতানগুলোর ক্রেতা-দর্শনার্থী ছিল উচ্চবিত্তের লোকজন। তীব্র গরমের কারণে এবার মধ্য ও নি¤œমধ্যবিত্তদের অনেকেই ভিড় করছেন এসব মার্কেটে। অন্য মার্কেটের তুলনায় দাম একটু বেশি হলেও স্বস্তির কথা চিন্তা করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটগুলোতে কেনাকাটা করছেন তারা।
নগরীর প্রবর্তক মোড়ের মিমি সুপার, আফমি প্লাজা, জিইসি এলাকার সানমার, ইউনেস্কো সেন্টার, ২ নম্বর গেট এলাকার ফিনলে স্কয়ার, লালখান বাজারের আমিন সেন্টার, চকবাজারের কেয়ারি ইলিশিয়াম, বালি আর্কেড, সাফ আমিন প্লাজাসহ বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে মানুষের প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। নানা বয়সী মানুষকে পরিবার নিয়ে শপিং করতে দেখা গেছে। ক্রেতাদের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আসায় অভিজাত বিপণিবিতানের সামনে গাড়ির জটও লক্ষ্য করা গেছে।
ফিনলে স্কয়ারে আসা ইফতেখার উদ্দিন বলেন, প্রতিবছর আমরা রিয়াজউদ্দিন বাজারে শপিং করতে যাই। তবে এবার অতিরিক্ত গরমের কারণে ওই দিকে যাইনি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি। দাম অবশ্য একটু বেশি। তারপরও এসেছি।এ মার্কেটের দোকানি আরাফাত হোসাইন বলেন, রোজার প্রথম দিকেও কাস্টমার ছিল। তবে তখন দরদাম বেশি করতেন, কিনতেন কম। এখন দরদামের সঙ্গে কেনাকাটাও করছেন।
একসময় থান কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানা এলাকার বক্সির হাট। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে থানকাপড় এনে এখানে বিক্রি করা হত। তবে পরবর্তীতে এটির নাম হয় টেরিবাজার। ছোটবড় মিলিয়ে এ বাজারে এখন প্রায় আড়াই হাজার দোকান রয়েছে। এসব দোকানে এখন থানকাপড়ের পাশাপাশি শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্ট, স্যুটের কাপড় পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে আনা হয় এসব কাপড়। এছাড়াও এখানে অপেক্ষাকৃত কম দামের জাকাতের কাপড়, বিছানার চাদর, পর্দার কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় পাওয়া যায়।
তবে সময়ে ব্যবধানে এই টেরিবাজারে এখানে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক আধুনিক শপিং মল। নিউ রাজপরী, মেগামার্ট, সানা, শারীকা, মনেরেখসহ বিভিন্ন নামে শপিংগুলোতে এক ছাদের নিচে বিভিন্ন বয়সী মানুষের কাপড় মিলছে। আবার কোনো কোনো মলে কাপড়ের পাশাপাশি জুতা ও মেয়েদের কসমেটিকস সামগ্রীও মিলছে। এসব শপিং মলের বেশিরভাগই এক দামে বিক্রি করেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসব দোকানে সারাদিন ভিড় লেগেই থাকছে। একেকটি দোকানে দৈনিক ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
টেরিবাজার দোকানদার আবুল কালাম বলেন, থানকাপড় রোজার আগে এবং রোজা শুরুর পর প্রথম দিকে বেশি বিক্রি হয়েছে। এখন থ্রি-পিস এবং অন্যান্য তৈরি পোশাক বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ বছর ব্যবসা যথেষ্ট ভালো হয়েছে। ক্রেতারাও আসছেন। আমরা তাদের চাহিদামত পোশাক সরবরাহ করছি।
টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহমদ হোছাইন বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে এ টেরিবাজারে দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রির আশা করা হয়েছে। টেরিবাজারে রোজার আগে থেকে ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনা শুরু হয়েছে। প্রথমে থানকাপড় এবং শেষের দিকে এসে রেডিমেড কাপড় বেশি বিক্রি হয়।
কী নেই রিয়াজউদ্দিন বাজারে
তৈরি পোশাক, থান কাপড়, জুতার দোকান, কসমেটিকসের দোকান, চশমার দোকান, মোবাইলের দোকান, গৃহাস্থলি পণ্যের দোকান, ফলের আড়ত ও কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে প্রায় সবধরনের পণ্যের দোকান রয়েছে নগরের ঐতিহ্যবাহী রিয়াজউদ্দিন বাজারে। ঈদে মানুষ কাপড় ও জুতার পাশাপাশি অন্যান্য যাবতীয় সামগ্রী কিনতে ভিড় করেন চট্টগ্রামের অন্যতম এই বাণিজ্য কেন্দ্রে।
মোজাহিদ ক্লথ স্টোরের মালিক মো. মোজাম্মেল বলেন, এখন খুচরা কাস্টমার প্রচুর। পাশাপাশি আগে দোকানদারকে বাকিতে মালামাল বিক্রি করা হয়েছিল। শেষের দিকে এসে এসব টাকা তুলতে হয়। এ কারণে প্রচুর চাপ যাচ্ছে।
নি¤œ ও মধ্যবিত্তের ভরসা জহুর হকার্স মার্কেট
সাধ্যের মধ্যে ভালো কাপড় কিনতে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত লোকজন ছুটেন নগরের জহুর হকার্স মার্কেটে। চট্টগ্রাম আদালতের পাশে গড়ে ওঠা জহুর হকার্স মার্কেটে এখন চলছে ঈদের শেষ মুহূর্তের বেচাকেনা। ঐতিহ্যবাহী এই মার্কেটে সারাবছরই বেচা বেশি থাকে। তবে রমজান আসলে বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
মঙ্গলবার এই মার্কেটে প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। বিক্রেতারা পণ্য বিক্রির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। কোনো কোনো দোকানে স্তূপ বসিয়ে পণ্যের মূল্য ফিক্সড করে ক্রেতা আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। কোনো কোনো দোকানে হাঁকডাক করে কাস্টমার ডাকা হচ্ছে।
দোকানদার দিদারুল আলম বলেন, জহুর মার্কেটে ক্রেতারা একটু দরদাম বেশি করে। প্রথম দিকে মানুষ মার্কেটের অবস্থা বুঝার জন্য আসে। তবে শেষের দিকে এসে মোটামুটি বিক্রি হচ্ছে।
গৃহিণীরা ছুটছেন গোলাম রসুল মার্কেটে
গৃহাস্থলি পণ্যের জন্য বিখ্যাত নগরের গোলাম রসুল মার্কেটে এখন বিক্রেতাদের দম ফেলার ফুরসত নেই। এখানের প্রধান ক্রেতা গৃহিণীরা। রান্নাঘরের প্রতিটি পণ্য, ঘর সাজানোর নানা পণ্য এখানে পাওয়া যায়। ঈদকে সামনে রেখে অতিথিদের আপ্যায়ন করতে ঘরের গৃহিণীরা এখানে পণ্য কিনতে এসেছেন।
মার্কেটে আসা আফরোজা আলম বলেন, একটি ডিনার সেট এবং বাসার জন্য কার্পেট কিনতে এসেছি। এখানে মোটামুটি দামে মানসম্মত গৃহাস্থলি পণ্য পাওয়া যায়। তাই এসেছি। খবর ঢাকাপোস্ট।
এই মার্কেটের দোকানদার মো. আলমগীর বলেন, নারীরাই আমাদের এই মার্কেটে বেশি আসেন। কিচেনের জন্য এবং অতিথিদের আপ্যায়ন করতে তারা এখান থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনেন।
ভিড় আছে ফুটপাতের দোকানেও
নগরের বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতের দোকানগুলোর প্রধান ক্রেতা দিনমজুর-শ্রমিক গরিব মানুষ। নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারের নিউমার্কেট থেকে শাহ আমানত পর্যন্ত দুই পাশে এবং স্টেশন রোডের একপাশে কয়েকশ হকার রয়েছে। ঈদকেন্দ্রিক হকারদের এখানে সবচেয়ে বিক্রি বেশি হয়।
এছাড়া নগরের বিভিন্ন এলাকার সড়কে গড়ে ওঠা বিভিন্ন হকারের দোকানে বেচা-বিক্রির ধুম পড়েছে। এসব দোকানে ১০০ টাকার মধ্যে শার্ট কিংবা ২০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে প্যান্ট কেনা যায়। কম দামে এখানে পণ্য কিনতে পারায় ঈদের আগে দিনভর ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে হকারদের। একেকটি দোকানে প্রতিদিন ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা বেচাকেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
রিয়াজউদ্দিন বাজারের হকার মো. মহসীন বলেন, আমরা সীমিত লাভে পণ্য বিক্রি করি। কমদামে এখানে ভালো পণ্য পাওয়া যায়। এ বছর বিক্রি ভালো। ক্রেতাও আসছেন প্রচুর। কেনা দরের চেয়ে একটু বেশি দাম পেলেই পণ্য দিয়ে দিই।
ফুটপাতের দোকানে কেনাকাটা করতে আসা দিনমজুর কামাল উদ্দিন বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি। খাবারের খরচ মেটাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারপরও ঈদে বাড়ি যেতে হবে। ছোট দুটি মেয়ে আছে। তাদের জন্য কাপড় নিতে এসেছি। নিজের জন্য কিছু নেব না।
খাবারের দোকানের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো
রাতে বিভিন্ন দোকানে কেনাকাটার পাশাপাশি মানুষ খাবার ভিড় করেছেন খাবারের দোকানে। বিশেষ করে যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে বের হন কেনাকাটা শেষ করে মুখরোচক নানা খাবারের দোকানে তারা একবার হলেও ঢুঁ মারেন। ফুটপাতে রাতভর চটপটি ফুচকার দোকান, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ও বিভিন্ন খাবারের দোকান খোলা থাকে। আবার কেনাকাটা শেষ করে অনেকেই বাইরে সেহরি করে বাসায় ঢুকেন।
নিউমার্কেট ও স্টেশন রোড এলাকার হোটেল হান্নান আল ফয়েজ, এবিপি, হোটেল নিজাম, উজালা, বাঙালিয়ানা, গুলিস্তান, আল্লাহওয়ালাসহ বিভিন্ন হোটেল রাতভর খোলা থাকে।সোমবার রাতে হোটেল নিজামে পরিবার নিয়ে খেতে আসা নেওয়াজ উদ্দিন বলেন, বাচ্চাদের আবদার ছিল আজকে বাইরে খাবে। এখানে নানা পদের ভর্তা দিয়ে খাবার পাওয়া যায়। এজন্য শপিং শেষে এখানে খেতে এসেছি।
শহরজুড়ে কঠোর নিরাপত্তা
ঈদের কেনাকাটাকে কেন্দ্র করে রাতভর মানুষের উপস্থিতি থাকে শহরে। ব্যবসায়ীরাও এ সময় রাতে টাকা নিয়ে চলাফেরা করেন। দিনের মতো সড়কে চাপ থাকে রাতেও। যানজট লেগে থাকে বিভিন্ন মোড়ে। এসব বিষয় মাথায় রেখে রমজানে রাতে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করেছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ।
বিভিন্ন শিফটে বিভক্ত হয়ে ডিউটি পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। থানা পুলিশের নিয়মিত মোবাইল টিমের পাশাপাশি বিশেষ টহল টিম বিভিন্ন সড়কে দায়িত্ব পালন করছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার স্পিনা রানী প্রামাণিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা রাতদিন ডিউটি করছেন। আবার নিরাপত্তার জন্য ক্রাইম পুলিশ ইউনিটের অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়। এছাড়া সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যরা মাঠে কাজ করছেন। আবার অগ্নিকা- এবং নাশকতা বন্ধে সচেতন করতে বিভিন্ন মার্কেট মালিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের নগর পুলিশের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।