বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড : বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় বেশিরভাগ মৃত্যু

সুপ্রভাত ডেস্ক »

সাপ্তাহিক ছুটির আগের রাতে ভিড় বেশিই ছিল বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে, কাচ্চি ভাইসহ অন্য দোকানগুলো ছিল জমজমাট; কিন্তু ভয়াবহ এক আগুনে ভবনটি রূপ নেয় মৃত্যুপুরীতে।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে আগুন লাগার পর ধীরে ধীরে আসতে থাকে মৃত্যুর খবর। হাসপাতাল থেকে ছুটতে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্স, সারি সারি মরদেহ নিয়ে যায় মর্গে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থল আর মর্গে ভিড় করতে থাকেন স্বজনেরা। আহাজারি আর শোকে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। এমন ভয়াবহতা দেখে ভড়কে যাওয়া বেইলি রোডের বাসিন্দাদের কেবলই আক্ষেপ- চোখের সামনে কী হয়ে গেল!
জমজমাট বেইলি রোডের ওই ভবনে অগ্নিকাণ্ডে এত মানুষের মৃত্যু দেখতে হবে, প্রথমে তা ভাবেনি কেউই। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখার তেজ কমে আসার পর একে একে বের হতে থাকে মরদেহ। পরে হাসপাতালেও মৃত্যু হয় অনেকের।
২০১১ সালে একটি বেইজমেন্টসহ আট তলা আবাসিক কাম বাণিজ্যক ভবন হিসেবে গ্রিন কোজি কটেজের নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক।
এত মানুষের মৃত্যুর পেছনে আগুনে পোড়া ছাড়াও বিষাক্ত কালো ধোঁয়াকেও কারণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। আগুন লাগার পর উত্তাপ আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় গ্রিন কোজি কটেজের ওপরের তলাগুলো।
শুক্রবার ঢাকা মেডিক্যাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট পরিদর্শন করে ৪৬ জনের মৃত্যুর তথ্য দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন।
এই চিকিৎসক বলেন, যারা মারা গেছেন তারা কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ, একটা বদ্ধ ঘরে যখন বের হতে পারে না, তখন ধোঁয়াটা শ্বাসনালীতে চলে যায়। প্রত্যেকেরই তা হয়েছে। খবর বিডিনিউজ।
যাদের বেশি হয়েছে, তারা মারা গেছেন। তবে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তারাও কেউ শঙ্কামুক্ত নয়।
কার্বন মনোক্সাইড বিষাক্ত গ্যাস। সাধারণত কাঠ ও কয়লার মত জ্বালানি কিংবা গাড়ির ধোঁয়া থেকে এর উৎপত্তি হয়। আবদ্ধ জায়গা বা বায়ু চলাচল নেই এমন জায়গায় কার্বন মনোক্সাইডের বিষক্রিয়া ঘটে।
বেইলি রোডের ভবনটিতে আগুনের ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট এই গ্যাসেই অনেকে মারা গেছেন বলে জানান বার্ন ইনস্টিটিউটগুলোর প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।
অগ্নিকাণ্ডের সময় কেউ আটক পড়লে ধোঁয়ায় তার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। গরম কালো ধোঁয়া গলা দিয়ে প্রবেশের সময় নরম টিস্যু পুড়ে যায়, যা শরীরে বিষের মত প্রবেশ করে বলে মনে করেন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল।
তিনি বলেন, যারা আগুনে পুড়ে মারা যান, তাদের শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গের ভেতরে তাপে বা পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। আবার আগুনের ধোঁয়ার কারণে শ্বাস নিতে না পারায় কারো কারো মৃত্যু হয়।
শ্বাসপ্রশ্বাস ছাড়া মানুষ এক দণ্ড বাঁচতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় অক্সিজেনের। আগুনের ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। এই কার্বন মনোক্সাইডের মধ্যে শ্বাস নিতে গেলে অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং সেক্ষেত্রে মানুষ মারা যায়।
বেইলি রোডের ঘটনায় গরম কালো ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে গিয়েই শ্বাসনালীর নরম টিস্যু পুড়ে এবং অক্সিজেনের অভাবে অধিকাংশ মারা গেছেন বলে মনে করেন পার্থ শংকর পাল।
তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে শরীরে আগুনের পোড়ার কোনো চিহ্ন থাকে না।
অগ্নিকাণ্ডের ওই ঘটনায় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিউটে ভর্তি আছেন ১০ জন। আর ঢাকা মেডিক্যালে আছে দুইজন।
ভর্তি সবাই দগ্ধ এবং তাদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, তারা কেউই শঙ্কামুক্ত নয়।
গ্রিন কোজি কটেজের দ্বিতীয় তলায় ছিল বিরিয়ানির পরিচিত খাবার দোকান ‘কাচ্চি ভাই’ এর শাখা, তৃতীয় তলায় পোশাকের ব্র্যান্ড ইলিয়েন।
নিচের তলায় স্যামসাংয়ের শোরুমসহ আরো বেশ কিছু দোকান। স্যামসাংয়ের শোরুমের পাশে রয়েছে একটি কফি শপ।
পিজা ইন, অ্যামব্রোসিয়া, জেস্টি ও স্ট্রিট ওভেনসহ অনেকগুলো দোকান ও রেস্তোরাঁ রয়েছে ভবনটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। খাবারের দোকানগুলোর কারণেই সবসময় জমজমাট থাকত ভবনটি।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মাত্র একটি সিঁড়ি ও ভবনের একটি ছাড়া প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে খাবারে দোকান থাকায় গ্যাস সিলিন্ডারগুলো রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে। খবর বিডিনিউজ।
আইন অনুযায়ী কোনো ভবন ১০ তলার বেশি উচ্চতার হলে সেখানে ফায়ার এক্সিট লাগে। কিন্তু ওই ভবনটি আট তলা, তাই ফায়ার এক্সিট রাখা হয়নি।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পাবিদন আশরাফুল ইসলাম বলছেন, একমাত্র সিঁড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার, দোকানের মালামাল রাখা ছিল। ফলে লোকজন বের হতে পারেনি।
আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ভবনটি যেহেতু বাণিজ্যিক, সেহেতু আলাদা অগ্নি নির্গমণ পথ রাখা দরকার ছিল বলে মনে করেন আশরাফুল।
তিনি বলেন, আবাসিক ভবন হলে কম লোক বাস করেন, আগুন লাগলে দ্রুত নামতে পারেন। কিন্তু বাণিজ্যিক ভবনে বহু মানুষ আসা-যাওয়া করে।
র‌্যাবের ডিজি খুরশীদ আলম ঢাকা মেডিক্যালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের দেখার পর সাংবাদিকদের বলেন, আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল ভবনের নিচের একটি ছোট দোকানে। সেখানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণেও এনেছিলেন। তবে পরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
অধিকাংশ মানুষই ধোঁয়ার কারণে শ্বাসরোধে মারা গেছেন। ভবনটিতে একটি মাত্র সিঁড়ি ছিল। দুইটি লিফট ছিল। আগুন লাগার পর মানুষ নামতে পারেনি।’
গলদ কোথায় ছিল
ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের নকশা এবং ভবন ব্যবহারের অনুমোদন ছিল; তারপরও কেন আগুন ভয়াবহ রূপ পেল এবং কেন এত প্রাণহানি ঘটল, তা খতিয়ে দেখার কথা বলছে রাজউক।
২০১১ সালে একটি বেইজমেন্টসহ আট তলা আবাসিক কাম বাণিজ্যক ভবন হিসেবে গ্রিন কোজি কটেজের নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক। ওই ভবনের জমির মালিক হামিদা খাতুন। আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন সেখানে ভবনটি তৈরি করেছে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পাবিদন আশরাফুল ইসলাম বলেন, ভবনের নকশা অনুমোদন করা আছে, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদনও আছে। আগুন লাগার পরপরই রাউজকের একদল কর্মকর্তা সেখানে যায়। সেখানে তারা দেখেছেন ভবনের সিঁড়ি নকশা অনুযায়ীই ছিল। অন্য কোনো ব্যত্যয় ছিল কি না সেটা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

আইন অনুযায়ী কোনো ভবন ১০ তলার বেশি উচ্চতার হলে সেখানে ফায়ার এক্সিট লাগে। কিন্তু ওই ভবনটি আট তলা, তাই তারা ফায়ার এক্সিট রাখেনি। আবার একমাত্র সিঁড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার, দোকানের মালামাল রাখা ছিল। ফলে লোকজন বের হতে পারেনি।
কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, তা নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লাগতে পারে বলে প্রথমে বলেছিলেন। পরে তিনি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের তথ্য পাওয়ার কথাও বলেন।
আর
অগ্নিকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে থাকা র‍্যাব-৩ এর এএসপি কামরুল হাসান বলেছিলেন, স্যামসাং শোরুমের (নিচতলায়) পাশের কফি হাউস থেকে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা নিচ থেকে আগুন উপরের দিকে উঠতে দেখেছেন। প্রথমে দোতলায় তারপর তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে যায়।
র‌্যাবের ডিজি খুরশীদ আলম ঢাকা মেডিকেলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের দেখার পর সাংবাদিকদের বলেন, নিচের একটি ছোট দোকানে প্রথমে আগুন লেগেছিল। সেখানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। তবে পরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষই ধোঁয়ার কারণে শ্বাসরোধে মারা গেছেন।
তিনি বলেন, ভবনটিতে একটি মাত্র সিঁড়ি ছিল। দুইটি লিফট ছিল। আগুন লাগার পর মানুষ নামতে পারেনি।
বার বার নাম আসা কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক আবদুল হালিমও বলেছেন, তাদের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়নি।
আগুনের সূত্রপাত নিচ তলার চুমুক রেস্টুরেন্ট থেকে। আমি নিজে দেখেছি সেখান থেকেই প্রথমে আগুনের ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
যেভাবে আমরা মিডিয়ায় দেখলাম যে, কাচ্চি ভাই থেকে এই করছে, হেই করছে। কাচ্চি ভাইয়ের ওখানে আপনারা উঠে দেখুন এখনো কাচ্চি ভাইয়ের কিচেন যেটা পেছনে, সেই কিচেন ঠিক আছে। আগুনের চিহ্ন পাবেন না। আগুন লাগছে সামনে। তাহলে কাচ্চি ভাইয়ের কিচেন থেকে আগুন কীভাবে লাগল আপনারা বলেন?
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, গ্রিন কোজি কটেজ বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। তবে ভবনে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধ ট্রেড লাইসেন্স আছে কি না তাও দেখা হবে।