কামরুল হাসান বাদল »
প্রতিটি স্বাধীন জাতি বা রাষ্ট্রের একটি স্বাধীনতা দিবস থাকে কিন্তু সবার বিজয় দিবস থাকে না। আমাদের স্বাধীনতা দিবস আছে, আমাদের বিজয় দিবসও আছে। কারণ আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে ৯ মাসেরও অধিক সশস্ত্র যুদ্ধ করে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করেছি। কাজেই আমরা শুধু স্বাধীন জাতি নই, আমরা বিজয়ী জাতিও। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তি আমরা রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছি। কারো দয়ায় তা পাইনি কিংবা টেবিলে বসে আলোচনা করেও তা অর্জন করিনি।
১৯৪৭ এর দেশ ভাগে বাঙালির প্রকৃত কোনো অর্জন হয়নি। বরং এক ঔপনিবেশিক শাসন থেকে আরেক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলা পরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। ফলে প্রকৃত স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা এ দেশের মানুষের অন্তরে রয়েই যায়। এই আকাক্সক্ষার প্রথম অঙ্কুরোদগমন ঘটে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেদিনের সে ভাষা আন্দোলন, যা ছিল মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন, তা-ই বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ধাপ।
১৯৫২ থেকে জেগে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রাপথে রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনও পরিচালিত হয়েছিল সমান্তরালভাবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সে সংগ্রাম ও আন্দোলনে দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক তথা বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও নেমে এসেছিলেন রাজপথে। স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে তারাও রাজনীতিকদের পাশাপাশি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে তার চূড়ান্ত পরিণতি।
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, ইতিহাসের রাখাল রাজা, রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণে বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন।
মাত্র তেইশ বছরের ব্যবধানে এই উপমহাদেশে আরেকটি প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধিকার, সমঅধিকার ও নিজেদের প্রাপ্য সুনিশ্চিত করতে ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি প্রণীত করেছিলেন এবং এক আশ্চর্য সম্মোহনী শক্তিতে মাত্র ৪ বছরের মধ্যে স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিলেন।
হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো এক আশ্চর্য মোহনীয় জাদুতে ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন ও একটি সুমহান জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রণা দিয়েছিলেন।
২৬ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘুমন্ত জাতির ওপর নির্মম-তুলনারহিত বর্বরোচিত হামলা চালালে। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে শহিদ হয় ত্রিশ লাখ মানুষ। ধর্ষিত হয় প্রায় তিন লাখ নারী। এক কোটি মানুষকে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে হয়। প্রায় নয় মাসব্যাপি পাকিস্তানিরা এদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। বিশ্বের ইতিহাসে ২৬৬ দিনে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করার নজির কোথাও নেই। নয় মাস মরণপণ যুদ্ধের পরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিজয় লাভ করে জাতি।
বায়ান্ন বছর আগে আর বায়ান্ন বছর পরের বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তর ফারাক আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে। দেশ এগিয়ে গেছে বহুদূর। বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন বিশ্ব রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, প্রশংসিত হচ্ছে। এই অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে হবে আমাদের যে কোনো শর্তে। দেশি-বিদেশি কোনো অপশক্তি যেন অগ্রসরমান বাংলাদেশের পথে প্রতিবন্ধক হতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে সবাইকে। মনে রাখতে হবে দেশটি সতেরো কোটি বাঙালির।
নানা কর্মসূচি
জাতীয় পর্যায়ে এদিন ঢাকায় প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুস্পস্তববক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থনরত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণকারী আমন্ত্রিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যগণ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী প্রদান করেছেন।
দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে। এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু বিকাশ কেন্দ্রসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। দেশের সকল শিশুপার্ক ও জাদুঘরসমূহে বিনা টিকিটে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং সিনেমা হলে বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হবে।