সুপ্রভাত ডেস্ক »
কুমিল্লাকে নিয়ে গঠন হতে যাওয়া বিভাগের নাম সরকার ‘মেঘনা’ করার উদ্যোগ নিলেও ক্ষমতায় গেলে ‘কুমিল্লা’ নামেই তা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। গতকাল শনিবার বিকালে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বিভাগীয় সমাবেশে তারা এ ঘোষণা দেন।
একইসঙ্গে বিভিন্ন দাবিতে ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে কুমিল্লায় আয়োজিত এ জনসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম এখনই সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন। খবর বিডিনিউজের।
তিনি বলেন, ‘এখন বাংলাদেশ আপনাদের বিদায় দেখতে চায়। দয়া করে সময় থাকতেই মানে মানে কেটে পড়ুন। তা না হলে এদেশের আপনাদেরকে বিদায় করবে।’
নতুন বিভাগ গঠন প্রসঙ্গে সরকার ‘মেঘনা’ নামের কথা বলে আসলেও তা বোঝাতে বিএনপি নেতারা সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে ‘গোমতী’ নাম উচ্চারণ করেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সমাবেশের প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘কী গোমতী হবে, না কুমিল্লা হবে? কুমিল্লা।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি বলতে চাই, এই কুমিল্লা ঐতিহাসিক কুমিল্লা। এই কুমিল্লা নিয়ে আমরা গর্বিত। আজকের সরকারপ্রধান কুমিল্লার জনগণকে দেখতে পারেন না। কুমিল্লাকে সেই সরকার আপনারা দেখেছেন নানাভাবে অপবাদ দেয়। আমরা এই সমাবেশ থেকে বলতে চাই, চাঁদপুর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কুমিল্লা উত্তর, কুমিল্লা দক্ষিণ এবং কুমিল্লা মহানগরের জনগণ ‘কুমিল্লা’র নামে দেখতে চায়।’
কুমিল্লার দাউদকান্দির সাবেক এই এমপি বলেন, ‘আজকের সরকার প্রধান যদি হীনমন্যতার পরিচয় দিয়ে আমাদের ঐহিত্যবাহী কুমিল্লার নামকে অন্য নামে পরিচিত করতে চান- আমরা কুমিল্লাবাসী ওটা মানব না, মানতে পারি না।’
আজ রোববার অনুষ্ঠেয় প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভার আলোচ্যসূচিতে নতুন দুই বিভাগ ‘মেঘনা’ ও ‘পদ্মা’ অনুমোদনের প্রস্তাব ওঠার কথা রয়েছে।
বৃহত্তর কুমিল্লা ও আশপাশের জেলাগুলো নিয়ে ‘মেঘনা’ (বিএনপি নেতাদের ভাষায় ‘গোমতী’) এবং বৃহত্তর ফরিদপুরের জেলাগুলোকে নিয়ে ‘পদ্মা’ বিভাগ করতে যাচ্ছে সরকার। বর্তমান দেশে বিভাগের সংখ্যা ৮টি। এগুলো হচ্ছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ।
আগের রাত থেকেই কানায় কানায় পূর্ণ টাউন হল ময়দানে বিএনপির বিভাগীয় এ সমাবেশ শনিবার সকাল ১১টা শুরু হয়ে শেষ হয় বিকাল ৫টায়। মাঠের আশপাশের এলাকাও নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে ‘জনসমুদ্রে’ রূপ নেয়। হলুদ-লাল টুপি ও রঙিন গেঞ্জি পরিহিত নেতাকর্মীরা অনেকের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, জাতীয় পতাকা ও ধানের শীষ দেখা গেছে। কুমিল্লা ছাড়াও ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুর জেলা থেকেও নেতাকর্মীরা এ সমাবেশে অংশ নেন।
সমাবেশের মঞ্চে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জন্য তাদের ছবি রেখে আসন সংরক্ষিত রাখা হয়।
জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের ‘হত্যার প্রতিবাদে’ এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিভাগীয় সমাবেশের এ কর্মসূচি চালিয়ে আসছে বিএনপি।
সমাবেশে ‘গুম হওয়া’ সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম হিরু ও হুমায়ুন কবির পারভেজের ছেলেরা এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ‘পুলিশের গুলিতে’ নিহত ছাত্রদল নেতা নয়ন মিয়ার বাবা রহমত উল্লাহ বক্তব্য রাখেন।
‘আর নৌকায় জনগণ উঠবে না’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘উনি (শেখ হাসিনা) আবার নির্বাচন করবেন। পরশু দিন উনি সরকারি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে, রাষ্ট্রের সমস্ত যন্ত্র ব্যবহার করে, হাজার হাজার বাস-ট্রাক নিয়ে যশোরে সভা করেছেন। এমনকি স্টেডিয়ামের গ্যালারি পর্যন্ত ভেঙে দিয়ে তারা সভা করেছেন। এই সভায় তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগ আসলে জনগণ শান্তি পায়। শান্তিতে আছেন আপনারা, শান্তিতে নাই আপনারা।
‘আবার বলেছেন, আবার নৌকায় ভোট দেন। শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের একটা গান ছিল- ‘আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় উঠতাম (চড়তাম) না’। বাংলাদেশের সব মানুষ এখন এই গান গাইতে শুরু করেছে- ‘আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় উঠতাম (চড়তাম) না’। ভুলে যান ওই নৌকার কথা ভুলে যান।’
নির্বাচন নিরেপেক্ষ হলে ‘আওয়ামী লীগের কি জামানত থাকবে?’- প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘সেজন্য ওরা ফন্দি-ফিকির বের করেছে। কী ফন্দি-ফিকির? বলছে যে, আগের মত ভোট হবে। অর্থাৎ ওরা থাকবে ক্ষমতায়, শেখ হাসিনা থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, এমপিরা থাকবে এমপি, মন্ত্রীরা থাকবে মন্ত্রী। আর আমরা ভোট দেব। আবার কিসে ভোট হবে? ইভিএমে। যেমন খুশি, তেমন চুরি করবে। এ টার জন্য তারা আবার গায়েবি মামলা দেওয়া শুরু করেছে।’
তার অভিযোগ, ‘রাজশাহীতে গত ১১ দিনে ৩৫টা গায়েবি মামলা করেছে আর সারাদেশে ১০৪ টার মত মামলা দিয়েছে। একটা পত্রিকায় হেডলাইন দিচ্ছে- ককটেল ফাটিয়েছে। বলছে যে, আমরা এত ককটেলের একটা আওয়াজও শুনলাম না। পাবলিক বলছে, এত ককটেল বিস্ফোরণ কেউ শুনেনি, কেউ দেখেনি।’
‘এত বড় মিথ্যাচার, লজ্জাও নাই, শরমও নাই। এদের চামড়া গ-ারের মত মোটা হয়ে গেছে। বেশরম-বেহায়া ওরা।’
‘মিথ্যা মামলা’ দিয়ে সরকার বিএনপি নেতাদের বিচার কাজ দ্রুত করছে বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।
তার ভাষায়, ‘এখানে আমাদের স্যারেরা, আমাদের নেতারা বসে আছেন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ১০/২০/৫০/৬০টা মামলা। শুধু তাই নয়, মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের ট্রায়ালকে দ্রুত করে দিয়ে যাচ্ছে আবার, আবার দ্রুত বিচার করতে চাচ্ছে।’
‘অর্থাৎ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে যেভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে সাজা দিয়ে আটক করে রেখেছে চার বছর ধরে, আমাদের তারেক রহমানকে যেভাবে নির্বাসিত করেছে; ঠিক একই কায়দা আমরা যারা- এখন লড়াই করছি, সংগ্রাম করছি তাদেরও আজকে কারাগারে নিক্ষেপ করে সহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না, আবারও দাবি করে তিনি দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
‘ঢাকায় ১০ তারিখে সমাবেশ হবেই’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ঢাকা শহরেও গায়েবি মামলা আবার দেওয়া শুরু করেছে। ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ করবে- ওইটা যেন না হতে পারে, তার জন্য আগে থেকে মামলা দেওয়া শুরু করেছে ওরা। ঘরে ঘরে অভিযান চালাচ্ছে। তাতে কি ঢাকার সমাবেশ বন্ধ করা যাবে? কুমিল্লারটা বন্ধ করতে পারেনি। রাজশাহী ও ঢাকাতেও বন্ধ করা যাবে না।’
‘অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়েছে’
সরকারি কোষাগার খালি হয়ে পড়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের চুরির কথা বলতে গেলে দিন-রাত পার হয়ে যাবে। এতো বলতে চাই না-এখন সময় কম। শুধু এইটুকু বলি যে, ফোকলা করে দিয়েছে। ট্রেজারিতে আর কিচ্ছু নাই।’
অর্থপাচারের অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের আয় বাড়ে না। ওদের (সরকারি দলের) আয় বাড়ে। ওরা ফুলে ফুলে এই মোটা হচ্ছে। দেখছেন না- কী রকম! চার তলা বাড়ি থেকে ১০তলা বাড়ি হয়, একটা দামি গাড়ি থেকে ১০টা হয়, ওদের সব লোকে দেখবেন যে, চেহারা অত্যন্ত সুন্দর হয়ে গেছে।’
বক্তৃতার শুরুতে বিএনপি মহাসচিব কুমিল্লার প্রয়াত রাজনীতিক কাজী জাফর আহমেদ, অলি আহাদ, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আকবর হোসেন, কুমিল্লার ‘বার্ড’ (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি) প্রতিষ্ঠাতা ও ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খান এবং সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। একই সঙ্গে দলের ভাইস চেয়ারম্যান অসুস্থ রাবেয়া চৌধুরীকেও স্মরণে আনেন তিনি।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াছিনের সভাপতিত্বে ও দক্ষিণের সদস্য সচিব মো. জসিম উদ্দিন, উত্তরের এএফএম তারেক মুন্সি ও মহানগরের ইউসুফ মোল্লা টিপুর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক শাহিদা রফিক, অ্যাডভোকেট বোরহান উদ্দিন, কেন্দ্রীয় নেতা মোস্তাক মিয়া, জাকারিয়া তাহের সুমন, আবুল কালাম আজাদ, খালেদ মাহবুব শ্যামল, জেড খান মো. রিয়াজ উদ্দিন নসু, হারুনুর রশীদ, রাশেদা বেগম হীরা, অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া, শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, সাইয়েদুল হক সাঈদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, আবদুল খালেক, তকদির হোসেন মো. জসিম, রফিক শিকদার, মঞ্জুরুল আহসান মুন্সি, ব্যারিস্টার খন্দকার মারুফ হোসেন, সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, মমিনুল হক, জালাল উদ্দিন, এসএম কামাল উদ্দিন চৌধুরী, মোস্তাক খান সফরী, মাহবুবুল ইসলাম মাহবুব, কাজী রফিক, শেখ মো. শামীম, একরামুল হক বিপ্লব, সাবেরা আলাউদ্দিন হেনা, জিয়া উদ্দিন জিয়া, মোশাররফ হোসেন, সালাহউদ্দিন ভুঁইয়া শিশির, আবদুস সাত্তার পাটোয়ারি, শফিকুল ইসলাম মিল্টন, আকরাম হোসেন মিন্টু, কুমিল্লা মহানগরের উদকতাকুল বারী আবু, উত্তরের আখতারুজ্জামান সরকার, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার জিল্লুর রহমান জিল্লা, হাফিজুর রহমান কচি, চাঁদপুরের সলিমুল্লাহ সেলিম।
এছাড়া যুবদলের মোনায়েম মুন্না, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, হেলেন জেরিন খান, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসাইন, স্বেচ্ছাসেবক দলের এস এম জিলানি, ইয়াছিন আলী, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের হারুন আল রশিদ, জাসাসের হেলাল খান, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ, উলামা দলের শাহ নেছারুল হক, মৎস্যজীবী দলের আবদুর রহিম, ছাত্রদলের কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বক্তব্য দেন।
সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, চেয়াপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
গরমে মঞ্চে উকিল আবদুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।