নিজস্ব প্রতিবেদক, খাগড়াছড়ি »
কলেজ জীবনে বিপুল চাকমা’র রুমমেট সাংবাদিক হিমেল চাকমা জানান, সামাজিক মাধ্যমে মঙ্গলবার সকালে চারটি দেহের মধ্য মেঝেতে বিপুলের মরদেহ দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।
তার কারণ বিপুল আমার সাথে ছিল প্রায় ৬ মাস। খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে পড়াকালীন কলেজের পেছনে বাঙালি পাড়ায় ভাড়া বাসায় এক বিছানায় থাকতাম। আমার রান্না বিপুল খেয়েছে। আমিও বিপুলের রান্না খেয়েছি। বিপুল তখন শুধু একজন ছাত্র ছিল। রাজনীতি করত না। আমি অনার্স পড়তে রাঙামাটি পাড়ি জমালে সে রাজনীতিতে জড়ায়। অল্প সময়ে সে বড় পদ পায়। বিপুলের মৃত্যু আমাকে আহত করেছে চরমভাবে।
খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় সোমবার রাতে দুর্বত্তের গুলিতে নিহত ইউপিএফ সমর্থিত সহযোগী সংগঠর তিন তরুণ নেতা এবং ইউপিডিএফ কর্মী রুহিনসা ত্রিপুরা’র মরদেহ বুধবার শেষ বিকেলে পানছড়ির প্রত্যন্ত তারাবনছড়ায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। মূলত সবার বাড়ি এক জায়গায় না হলেও বৈরি বাস্তবতায় পরিবারের স্বজনদের সম্মতিতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন, ইউপিডিএফ-খাগড়াছড়ি অঞ্চলের সংগঠক অংগ্য মারমা।
নিহত চারজনের মধ্যে রুহিনসা ত্রিপুরা ছাড়া বাকি তিনজনই ছিলেন অবিবাহিত এবং বয়সসীমা পঁয়ত্রিশের নিচেই।
এরমধ্যে গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা’র বাড়ি পানছড়ি হবার কারণে তারাবনছড়া নামক এলাকায় অনুষ্ঠিত দাহক্রিয়ায় কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। শিশু-নারী থেকে শুরু সববয়সী মানুষের অংশগ্রহণকে এলাকার সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিরা জানান, বিনয়ী বিপুল চাকমা’র রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার কারণেই এমন লোক সমাগম ঘটেছে।
বিপুলের প্রাথমিক ও পানছড়ি মডেল হাইস্কুলের শিক্ষকরা জানান, বিপুল লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলো। তারচেয়েও বেশি তাঁর মধ্যে পাহাড়ি জনগণের প্রতি একটা মমত্ববোধ পরিলক্ষিত হতো।
পানছড়ির চেঙ্গী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের করল্যাছড়ি গ্রামের বুদ্ধধন পাড়ার সুনয়ন চাকমার একমাত্র ছেলে বিপুল চাকমা (৩২) গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে ২০০৬ সালে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ওখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের রাজনীতিতে জড়ান। সহপাঠী ও সহকর্মীরা জানান, ২০১০ সালে ঢাকার তিতুমীর কলেজে মাস্টার্স করাকালে ঢাকার রাজপথেও বিপুল পরিচিতি অর্জন করেন, বাকপটু বিপুল চাকমা।
প্রায় দেড় দশকের রাজনৈতিক জীবনে বিপুল রাজধানীতে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। ফলে তাঁর অপ্রত্যাশিত হত্যাকা-ের পর ‘বাম গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট’ মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদী মশাল মিছিল করেছে।
২০১৬ সালের ২৫ অক্টোবর বিপুল চাকমা’র মা দূরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যান। ওই সময় বিপুল রাজনৈতিক মামলায় খাগড়াছড়ি কারাগারে বন্দি ছিলেন। প্যারোলে মুক্তি পেয়ে পুলিশ প্রহরায় মায়ের দাহক্রিয়া অনুষ্ঠানে তাঁর আবেগঘন এক রাজনৈতিক বক্তব্য এখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই অনুষ্ঠানেও তাঁকে একনজর দেখতে প্রত্যন্ত করল্যাছড়ি গ্রামে অঢেল মানুষের উপস্থিতি ঘটেছিলো।
সোমবার রাত আনুমানিক ১০টার দিকে রোমহর্ষক এই হত্যাকা- ঘটে। পানছড়ি পুলিশ লাশগুলো উদ্ধার করে ১৮ ঘণ্টার পর মঙ্গলবার শেষ বিকেলে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পোস্টমর্টেম চলাকালে অনেক মানুষ যে যার মতো লাশগুলো দেখার চেষ্টা করছিলো। তাঁদের একজন বিপুলের বন্ধুর ছোট বোন রুপালি চাকমা।
তিনি বলেন, ভয় শঙ্কা উপেক্ষা করেই আমরা হাসপাতালে জাতির জন্য নিবেদিত তরুণদের শেষ দেখা সারতে এসেছি।
বিপুল চাকমা’র কাকীমা গৌরি চাকমা জানান, বংশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানটি রাজনীতির বলী হলো। তিনি দৃঢ়তার সাথে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তির দাবি ব্যক্ত করেন।
এদিকে এই ঘটনায় নিহত বিপুল চাকমার কাকা নিরুপম চাকমা বাদি হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করে বুধবার শেষ বিকেলে পানছড়ি থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন বলে জানিয়েছেন পানছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল আজম।
মামলার বাদি নিরুপম চাকমা বলেন, ‘ঘটনার সময় যেহেতু আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না তাই অপরাধীদের দেখিনি। সে জন্য অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করেছি। আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা এখন পুলিশের কাজ।
পানছড়ি থানার ওসি শফিউল আজম বলেন, এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। লাশ জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরবর্তী আইনগত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।
উল্লেখ্য, সোমবার (১২ ডিসেম্বর) রাত ১০টার দিকে পানছড়ি লোগাং ইউনিয়নের অনিলপাড়ায় ইউপিডিএফের চারজন নেতা-কর্মী নিহত হয়। নিহতরা হলেন ইউপিডিএফের গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা (৩২), গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের জেলা সহসভাপতি লিটন চাকমা (২৯), পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুনীল ত্রিপুরা (২৯) ও ইউপিডিএফের সদস্য রুহিন বিকাশ ত্রিপুরা (৪৯)।