সুপ্রভাত ডেস্ক »
সরকারের বাস্তবসম্মত নীতির কারণে বাংলাদেশ বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও রপ্তানি বাণিজ্যের একটি আঞ্চলিক কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে মন্তব্য করে আরো বড় আকারে জাপানি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাসস জানায়, বৃহস্পতিবার টোকিওর ওয়েস্টিন হোটেলের গ্যালাক্সি বল রুমে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটের উদ্বোধন করে এ আহ্বান জানান বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। খবর বিডিনিউজের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বাস্তবসম্মত নীতি এবং দর্শনের কারণে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং এ অঞ্চলে এবং এর বাইরে বিভিন্ন গন্তব্যে রপ্তানি বাণিজ্যের একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ’ শিরোনামে এই সম্মেলনের আয়োজন করে।
এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জেসিসিআই এবং এফবিসিসিআই-এর সদস্য বিভিন্ন বাংলাদেশি ও জাপানি কোম্পানির মধ্যে ১১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ও (এমওইউ) বিনিময় হয়।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবায়াত-উল-ইসলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে মুনাফার হার বরাবরেই পেশি। পাশাপাশি ব্যবসাবান্ধব নীতি ও প্রণোদনা, স্থিতিশীল গণতন্ত্র, বিচক্ষণ শাসন ও নেতৃত্ব বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে ভালো মুনাফার নিশ্চয়তা দিচ্ছে।
‘আমরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য চমৎকার ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে পরে। তাই আমরা বিশ্বের বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে জাপানি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগগুলো দেখার আমন্ত্রণ জানাই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জাপানের কাছ থেকে আরও বিনিয়োগ চাই। আমি আপনাদের সবাইকে বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ নিজেই একটি বর্ধিষ্ণু বাজার। প্রায় তিন বিলিয়ন ভোক্তার একটি বড় বাজারের কেন্দ্রস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশ একটি আকর্ষণীয় স্থান।
এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চ প্রজেকশন রিপোর্টের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগদ যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হয়ে উঠতে যাচ্ছে, সে কথাও শেখ হাসিনা বলেন।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ফেলেছে।
‘তবে, আমরা কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকট মোকাবেলা করতে পেরেছি। আমাদের অর্থনীতি দারুণ সহনশীলতা দেখিয়েছে, প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে এবং বিশ্ব বাজারের অস্থিরতা ও সরবরাহ ঘাটতির চাপকে সামাল দিয়ে রেখেছে।
‘বাংলাদেশ ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছে এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৭.১% জিডিপি প্রবৃদ্ধি পেয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও আমরা চলতি অর্থবছরে ৬.৫% প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করেছি।’
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধনশীল অর্থনীতির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আইসিটি, ইলেকট্রনিক্স, অবকাঠামো, চামড়া, টেক্সটাইল, হসপিটালিটি ও পর্যটন, ভারী শিল্প, রাসায়নিক ও সার এবং এসএমইর মত খাতে সুযোগ অনেক বেড়েছে।
‘আমাদের সরকার ব্যবসা করার সাবলীল, সহজ এবং কার্যকর উপায়গুলো সহজতর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।’
বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সরকার দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাই-টেক এবং সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণ করছে, সে কথাও সরকারপ্রধান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘আমি জাপানি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে চাই, বাংলাদেশ আপনাদের জন্য প্রস্তত, এবং সেখানে গেলে আপনাদের অভিজ্ঞতা হবে চমৎকার। আপনাদের ব্যবসার সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সংস্থা এবং কাঠামো সুবিধা তৈরি করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, জাপানি বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি যৌথ অর্থনৈতিক সংলাপের (পিপিইডি) মত উচ্চ পর্যায়ের যৌথ প্ল্যাটফর্ম রয়েছে।
‘যেহেতু, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটাতে চলেছে, আমরা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের জন্য একটি অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি করার জন্য জাপানের সাথে কাজ করছি।’
বাংলাদেশি ও জাপানি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য যেসব কোম্পানি আজ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমি তাদের সফল অংশীদারত্ব কামনা করছি। আমরা জাপানি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিশেষ করে আড়াইহাজারে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ আশা করি।’
জাপানে বসবাসরত অনাবাসী বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তারা তাদের রেমিটেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
‘আমি তাদের আরো উদ্যোগ নিয়ে আসার এবং জাপানি বন্ধুদের সাথে যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি।’
বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই, আপনারা সবাই আমাদের উন্নয়ন ও অর্জনের অংশীদার হোন। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুন। আমরা নিশ্চিত, আপনার বিনিয়োগ আপনাকে সাফল্য এনে দেবে।’
রূপকল্প-২০২১ ও রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার যে ধারাবাহিকভাবে জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে, সে কথা শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে বলেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ বলা হচ্ছে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটালাইজেশন, খাদ্য উৎপাদন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।’
বাংলাদেশের মানুষ এখন আশা ও আশাবাদ নিয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের অপেক্ষায় আছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে একটি আধুনিক, উন্নত এবং জ্ঞানভিত্তিক ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর দিকে এগিয়ে যেতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’
গত বছর বাংলাদেশ জাপানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করেছে, সে কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে বিস্ময়করভাবে উন্নয়নের মডেলে পরিণত হওয়া জাপানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
‘আমাদেরও একই রকম গল্প আছে। আমাদের জাতির পিতা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারেননি, কারণ তাকে এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি ও আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমি আমার পিতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আধুনিক ও উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।’
আলোচনার শুরুতেই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দ্রুতই জাপান আমাদের নতুন দেশকে স্বীকৃতি দেয়। তারপর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাপান সফর করেন এবং দুই দেশের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের ভিত্তি রচনা করেন।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া উপস্থিত ছিলেন সম্মেলনে।
জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী নিশিমুরা ইয়াসুতোশি, জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেইটিআরও) চেয়ারম্যান ইশিগুরো নোরিহিকো, জাপান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেসিসিআই) কেন কোবায়াশিসহ জাপান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির সিইও ও শীর্ষ ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।