সাধন সরকার :
অনেক বেশি দিন ধরে বিরাজমান বৃষ্টিপাতহীন শুষ্ক আবহাওয়া হলো খরা। অনেক দীর্ঘ সময় ধরে শুষ্ক আবহাওয়া, বৃষ্টিপাতহীন অবস্থা ও উচ্চ তাপমাত্রাই খরার মুল কারণ। তাপে পানির অতিরিক্ত বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের (উদ্ভিদের পাতা ও অন্যান্য বায়বীয় অঙ্গ হতে জল বাষ্পাকারে বের হয়ে যাওয়া) পরিমাণ বৃষ্টিপাতের চাইতে বেশি হলে খরার অবস্থা তৈরি হয়। আমাদের দেশে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে মাঝেমধ্যেই খরার প্রকোপ দেখা যায়। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতাসম্পন্ন এলাকায়ও কখনো কখনো খরা হতে পারে! খরার তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের ফসল নষ্ট হয়। অনেক সময় এ খরার রেশ ধরেই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খরার সময় খরাপীড়িত অঞ্চল তপ্ত হয়ে ওঠে এবং কুয়া, খাল, বিল শুকিয়ে যাওয়ায় ব্যবহার্য পানির অভাব ঘটে, নদীর প্রবাহ কমে যায়, ভূগর্ভস্থ জলস্তর নিচে নেমে যায় এবং মাটির আর্দ্রতায় ঘাটতি দেখা দেয়।
প্রাচীনকাল থেকেই এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবজাতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে এসেছে। বাংলাদেশে সাধারণত বর্ষার আগে বা বর্ষার পরে খরা দেখা দেয়। বাংলাদেশের জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আর্দ্র বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি আর শুকনা মৌসুমে কম জল সরবরাহ খরার পরিবেশ সৃষ্টি করে। আন্তঃসীমান্ত নদীগুলিতে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণ পরিস্থিতিকে আরও অবনতিশীল করে তোলে। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল দিয়ে এদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের উজান এলাকায় পানি প্রত্যাহারের কারণে এসব নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নদীগুলিতে পানির স্বল্পতা ছাড়াও এ অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি পুনঃসঞ্চারণে (জমতে) নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের এ দু’অঞ্চলে আর্দ্রতার অভাবে মাঝেমধ্যে খরা দেখা দেয়। তবে বর্তমান সময়ে উত্তরাঞ্চলে খরার প্রকোপ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে বরেন্দ্রভূমি অঞ্চল বিশেষ করে দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, নাটোর, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলায় খরার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। আবহাওয়া বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে খরাকে স্থায়ী, মৌসুমি ও আপৎকালীন এই তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণত মৌসুমি ও আপৎকালীন খরা সংঘটিত হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে খরা হলেও বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ খরা সংঘটিত হয় ১৯৭৩ সালে, যা ১৯৭৪ সালের স্থানীয় দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী বলে ধরা হয়। খাবার পানি, চাষাবাদ ও পশুপালনের ক্ষেত্রে সরাসরি বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জন্য খরা একটি বড় সমস্যা।
বন্ধুরা জেনে থাকবে, উদ্ভিদ ও প্রাণী বিভিন্নভাবে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। সব প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য শক্তি প্রয়োজন। এ শক্তি কোথা থেকে আসে, জানো বন্ধুরা?
শক্তির প্রধান উৎস সূর্য। উদ্ভিদের সবুজ পাতার ক্লোরোফিল সূর্যের আলোকশক্তিকে শোষণ করে পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ব্যবহার করে সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করে। প্রাণী তার খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদ সূর্যের আলো ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করে ও তা সংরক্ষণ করে। ছোট ছোট প্রাণী এ খাদ্য খায়। আবার ছোট প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে বড় প্রাণী। এভাবেই পরিবেশে খাদ্যশৃঙ্খল তৈরি হয়। মূলত উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতে কে কাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তা নির্দেশ করে এই খাদ্যশৃঙ্খল। খাদ্যশৃঙ্খলের শুরুতে থাকে সরল সবুজ উদ্ভিদ।
আর শেষে থাকে বিরাট আকৃতির প্রাণী। খাদ্যশৃঙ্খলে নিচের স্তরের প্রাণিদের খায় তার ওপরের স্তরের প্রাণীরা। এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
এর ফলে উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতে ভারসাম্য বজায় থাকে। তবে দূষণজনিত বা প্রাকৃতিক কারণে কোনো উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণে সমগ্র জনসমষ্টির জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে। বাস্তুসংস্থানের (মানুষসহ সব উদ্ভিদ ও প্রাণী মিলে জৈব ও অজৈব উপাদানসমূহের অবিরাম প্রক্রিয়া) সকল উদ্ভিদ ও প্রাণী কোনো না কোনোভাবে খাদ্যশৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, ঈগল পাখি সাপ, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, ব্যাঙ ও অন্যান্য প্রাণিদের খেয়ে থাকে। আবার সাপও একইভাবে ইঁদুর, ব্যাঙ ও অন্য প্রাণিদের খেয়ে থাকে। একাধিক খাদ্যশৃঙ্খল একত্রিত হয়ে খাদ্যজাল তৈরি হয়। বন্ধুরা, তোমার নিকট পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করলে অনেক খাদ্যশৃঙ্খল দেখতে পাবে। যেগুলো একটি অন্যটির সাথে সম্পর্কিত।
খনিজ শব্দটি শুনে কি কঠিন মনে হচ্ছে, বন্ধুরা ? ভূপৃষ্ঠে বা ভূগর্ভে শিলাস্তূপ থেকে প্রাপ্ত মুক্ত মৌল বা যৌগ যা থেকে ধাতু বা অধাতু পাওয়া যায়, তাদেরকে খনিজ বলে। মূলত, এগুলো অজৈব পদার্থ এবং সাধারণভাবে কেলাসরূপে (কোনো কঠিন পদার্থের স্বচ্ছ, স্ফটিকাকার ও নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকৃতির গঠন) বিদ্যমান থাকে। সাধারণ শিলা বা পাথরের সাথে খনিজের মূল পার্থক্য হলো এদের নির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন রয়েছে যা সাধারণ পাথরের নেই। পৃথিবীতে ৫৩০০-এর বেশি খনিজ রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের খনিজ হলো : স্বর্ণ, রৌপ্য, সালফার, লোহা, তামা ইত্যাদি।
মাটির গভীরে রয়েছে বিভিন্ন খনিজসম্পদ। ভূ-পৃষ্ঠে অথবা ভূগর্ভের কোনো স্থানে সঞ্চিত খনিজসম্পদের অবস্থান মূলত সংশ্লিষ্ট স্থানের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও সময়কাল দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে সঞ্চিত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদসমূহ হচ্ছে : প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, কঠিনশিলা, নুড়িপাথর, কাচবালি, নির্মাণকার্যে ব্যবহৃত বালু, চীনামাটি, ইটের মাটি, পিট ও অন্যান্য। দেশের প্রধান খনিজসম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল ও কয়লা। চক, ধাতব মুদ্রা এবং নির্মাণসামগ্রী তৈরিতে খনিজ ও শিলা ব্যবহার করা হয়।