বাংলা শিশুসাহিত্যের সুলুকসন্ধান

অমল বড়ুয়া

সাহিত্য জাতির দর্পণ। সাহিত্যে পরিস্ফুট হয় জাতির মেধা ও মননের প্রতিচিত্র। সাহিত্যের পত্রপল্লব আর শাখা-প্রশাখার মধ্যে শিশুসাহিত্য অন্যতম। শিশুসাহিত্যের রয়েছে ঋদ্ধ ইতিহাস। বিশ্বসাহিত্যে শিশুসাহিত্যের বয়স প্রায় ছয় হাজার বছর। মিসরে রচিত প্রায় ছয় হাজার বছরের পুরোনো পৃথিবীর প্রাচীন শিশুসাহিত্যের গ্রন্থটির নাম- ‘কে’ জমনির হিতোপদেশ’। এর পাঁচ শ বছর পরে রচিত মিসরেই ‘টা-হোটেপের হিতোপদেশ’ নামে আরও একখানি শিশুসাহিত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে ‘সুত্ত-পাঠক’ নামে প্রথম যে শিশুতোষ গ্রন্থটির সন্ধান মেলে তার বয়সও চার হাজার বছর। আর বাংলা শিশুসাহিত্যের বয়স এখন প্রায় দেড় হাজার বছর। শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট গ্রন্থের মধ্যে প-িত বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্র’ অন্যতম। তবে এর পাশাপাশি বৌদ্ধজাতক সাহিত্যও গুরুত্বপূর্ণ। জাতক প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। ‘জাতক’ বৌদ্ধ ধর্মাদর্শ শিক্ষার জন্য সংকলিত; যা কালের বিচারে ‘পঞ্চতন্ত্র’ হতেও সুপ্রাচীন। প্রাচীন ভারতে রূপকথা সংকলিত হয়েছে সোম দেবের ‘কথাসরিৎসাগর’ এ। মুসলিম শাসনামলে আরব্য ও পারস্য সাহিত্যের সঙ্গে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফারসি ‘গুলে-বকাওলি’র অনবদ্য রোমান্স, ‘হাতেম তাঈর অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার ‘বাহার দানেশ’, সিন্দাবাদের সমুদ্রযাত্রার বিবরণ ও আলিবাবার গল্প শিশুমনে অসামান্য প্রভাব ফেলে। ইংরেজ আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের শিশুসাহিত্য ছিল এ রকমই। বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্যের গ্রন্থাদির বিকাশকাল ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে।
শিশুমনের উপযোগী সাহিত্যই হলো শিশুসাহিত্য। সাধারণত ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে এ সাহিত্যরচনা করা হয়। এই বয়স সীমার ছেলেমেয়েদের শিক্ষামূলক অথচ মনোরঞ্জক গল্প, ছড়া, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদিকেই সাধারণভাবে শিশুসাহিত্য বলে। ‘মুকুলে’ শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন যে নিতান্তই চার-পাঁচ বছরের শিশু বলতে যাদের বুঝায়, তাদের জন্য কোনো সাহিত্যরচনা সম্ভব নয়, সুতরাং শিশুর বয়োসীমা তিনি ৮/৯ থেকে ১৫/১৬ পর্যন্ত প্রসারিত করেছিলেন।
দুই
আঠারো শতকের শেষভাগে ১৭৭৮ সালে প্রথম মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। এরপরই গ্রন্থ, সাময়িকী, পত্রিকা প্রকাশনার কাজ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় জন মার্শম্যানের সম্পাদনায় ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় শিশুপত্রিকা ‘দিগদর্শন’। বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্যের গোড়াপত্তন হয় ১৮১৮ সালে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘নীতিকথা’ নামক গ্রন্থের মাধ্যমে। উপদেশমূলক ১৮টি গল্পের সমন্বয়ে প্রণীত এ গ্রন্থটি স্কুলপাঠ্যরূপে ব্যবহৃত হলেও প্রকৃতপক্ষে এটিই প্রথম শিশুপাঠ্য গ্রন্থ। শিশুসাহিত্যের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখের রচনার মাধ্যমে। ‘সাধনা’ পত্রিকার ১৩০১ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত ‘মেয়েলি ছড়া’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম ‘শিশুসাহিত্য’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত যোগীন্দ্রনাথের ‘খুকুমনির ছড়া’র ভূমিকায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ‘শিশুসাহিত্য’ কথাটি ব্যবহার করেন। শিক্ষার দিকে লক্ষ রেখে ছাত্রপাঠ্য বিচিত্র বিষয়বস্তুর সমাবেশে প্রচারিত এই পত্রিকাটিকেই আধুনিক বাংলা শিশুসাহিত্যের প্রথম সুচনা বলা যায়। উনিশ শতাব্দীতে ভারত উপমহাদেশে শিশুসাহিত্যের বিকাশ ঘটে মূলত ইংরেজ শাসনামলে।
ইংরেজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাংলা শেখানোর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৭ সালে ডেভিড হেয়ারের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজ। এই কলেজসমূহের পাঠ্যবই প্রণয়নে প্রধান সহায়ক ছিল অনুবাদ। উইলিয়াম কেরি ও অপরাপর প-িতদের অনুবাদ হতেই মূলত শিশুসাহিত্যের গোড়াপত্তন। কেরি, গোলোকনাথ শর্মা ও মৃত্যুঞ্জয় শিশুসাহিত্যের অগ্রযাত্রায় অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-বুক সোসাইটি প্রচুর শিশুপাঠ্য বই প্রকাশ করে। এতে এমন কিছু গ্রন্থের সন্ধান মেলে যেগুলো শিশুসাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে। ১৮১৮ সালে তারিণীচরণ মিত্র, রাধাকান্তদেব ও রামকমল সেনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘নীতিকথা’ নামক গ্রন্থ। ছোটদের জন্য রচিত এটাই বাংলা ভাষার প্রথম গ্রন্থ।
১৮২২ সালে ‘পশ্বাবলী’ নামে একটি বাংলা মাসিক পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। ১৮২৯ সালে প্রকাশিত ‘সদগুণ ও বীর্য্যরে ইতিহাস’ বইটি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৩১ সালে কৃষ্ণধন মিত্র ও রামচন্দ্র মিত্র ‘জ্ঞানোদয়’ নামে একটি তরুণপাঠ্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটাই ভারতীয়দের প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। ১৮৫৩-৫৪ সালে প্রকাশিত অক্ষয়কুমার দত্তের ‘চারুপাঠ’ বইটি ‘পাঠ্যগ্রন্থ’ হলেও বইটি শিশুদের জন্য জ্ঞানভা-ারে পরিণত হয়েছে। ১৮৫৫ সালে দুই খ-ে প্রকাশিত হওয়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ শিশুদের প্রথম পাঠ্যবই হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। ১৮৪৯-৫০ সালে প্রকাশিত হয় মদনমোহন তর্কালঙ্কারের তিন খ-ের ‘শিশুশিক্ষা’ বইটি। ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল …. এ কবিতার জন্য মদনমোহন তর্কালঙ্কার চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। এ কবিতাটির মধ্য দিয়ে বাংলা শিশুপাঠ্য কবিতার উন্মেষ ঘটে। এই সময়টা হচ্ছে শিশুসাহিত্যের প্রথম যুগ। বাংলা শিশুসাহিত্যের বয়স খুব বেশি নয়। মাত্র দুই থেকে আড়াইশ বছর। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববর্তী যুগে শিশুসাহিত্য ছিল নিছক উপদেশমূলক। এর মধ্যে থেকেই দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজমুদার, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং যোগীন্দ্রনাথ সরকার এসে শিশুসাহিত্যে বিপ্লবের জোয়ার বইয়ে দেন। বুদ্ধদেব বসু সেই স্বপ্নময় জগতের নাম দিলেন ‘শিশুসাহিত্যের সোনালি যুগ’। আর এখন চলছে শিশুসাহিত্যের আধুনিক যুগ।
তিন
শিশুসাহিত্যের দ্বিতীয়পর্বের সূচনা মূলত ১৮৫১ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও তাঁর প্রকাশিত পত্রিকা ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-এর মাধ্যমে। হরিনাথ মজুমদারের ‘বিজয় বসন্ত’ বাংলা শিশুসাহিত্যের প্রথম মৌলিক উপন্যাস। ১৮৬৯ সাল থেকে ১৯০০ সাল বাংলা শিশুসাহিত্যের জন্য খুবই তাৎপর্যময় সময়। ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি পত্রিকা ‘জ্যোতিরিঙ্গণ’ সার্থক শিশুপত্রিকা। এই পত্রিকার হাত ধরে দেশে শিশুপত্রের স্বর্ণযুগের শুভসূচনা হয়। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় কেশবচন্দ্র সেনের পাক্ষিক পত্রিকা ‘বালকবন্ধু’। ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয় প্রমদাচরণের ‘সখা’ পাক্ষিক পত্রিকা। শিশুশিক্ষায় এই পত্রিকা নতুন ইতিহাস রচনা করে। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয় জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় ‘বালক’ পত্রিকা। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত এই ‘বালক’ পত্রিকায় প্রথম শিশুসাহিত্যের লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘বালক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। ১৮৯৩ ও ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয় ভুবনমোহন রায়ের ‘সাথী’ এবং ‘সখা ও সাথী’ নামক পত্রিকা। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর উৎকর্ষধর্মী স্বনামধন্য শিশুসাহিত্য পত্রিকা ‘মুকুল’।
১৮৯৯ সালে প্রকাশিত যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘হাসিখুশি’ গ্রন্থের ‘হাট্টিমা টিম টিম, তারা মাঠে পাড়ে ডিম’ শিশুদের অপার আনন্দের খোরাক জোগায়। বাংলা শিশুসাহিত্যের বিবর্তন ও বিকাশে যাঁরা অগ্রনায়ক ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, গিরীন্দ্রমোহনী দাসী, দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু, জগদানন্দ রায়, হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, দীনেন্দ্রকুমার রায় ও জলধর প্রমুখ। ১৯০৬ সালে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ সংগ্রহ করে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বাংলার রূপকথাকে সাহিত্যে ছড়িয়ে দেন। বাংলা মৌখিক শিশুসাহিত্যের দ্বিতীয় বিষয় হলো ‘ছেলেভুলানো ছড়া’। দেশে বর্গীদের উপদ্রব নিয়ে রচিত হয় ছড়া ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে’। এ রকম আরো অনেক ছড়ার মধ্যে ‘আগডুম বাগডুম’ ছড়ায় আগে ডোম পিছে ডোম রায়বাঁশ ও ঢাল-তলোয়ার নিয়ে দিগি¦জয়ে বের হত; এই ছড়া বাঙালি ডোমের নির্ভীক বীরত্বের স্মৃতিবহন করছে।
মুসলমান শিশু সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রথমদিকের লেখক হলেন মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী। তিনি ‘নূরনবী’ (১৯১৮) নামে একটি উৎকৃষ্ট শিশুপাঠ্য জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। এ সময়ে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল : হাবিবুর রহমানের হাসির গল্প (১৯১৭), ইমদাদুল হকের কামারের কা- (১৯১৯), ইব্রাহিম খাঁর ছেলেদের শাহনামা (১৯২২), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর সিন্দাবাদ সওদাগরের গল্প (১৯২২), বন্দে আলী মিয়ার চোর জামাই (১৯২৯), মেঘকুমারী (১৯৩২), জঙ্গলের খবর (১৯৩৪), জঙ্গলের রাজা (১৯৩৭); মোহাম্মদ মোদাব্বেরের হীরের ফুল (১৯৩১), হবীবুল্লাহ বাহারের ওমর ফারুক (১৯৩১), আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কচিপাতা (১৯৩২) প্রভৃতি। বাংলাদেশের প্রথম সার্থক ছড়াকার জসিম উদ্দীনের বিখ্যাত ছড়াগ্রন্থ ‘হাসু’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৩-৩৮ সালের মধ্যে। জসিম উদ্দীনের ‘চলে মুসাফির’ একটি সুখপাঠ্য শিশুতোষ ভ্রমণকাহিনী। বাংলা ছড়ার আধুনিক রূপকার ফররুখ আহমদের বিখ্যাত ছড়াগুলোর মধ্যে ‘চিড়িয়াখানা’, ‘নতুন লেখা’, ‘পাখির বাসা’, ‘হরফের ছড়া’ উল্লেখযোগ্য। আঠার শতকের শেষের দিকে মোজাম্মেল হকের ‘পদ্যশিক্ষা’ আমাদের ছড়ার বিষয়ে একটি উৎসের সন্ধান দিয়ে যায়।
পরে যাঁরা শিশুসাহিত্যরচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন তাঁরা হলেন, গোলাম মোস্তফা, কাজী কাদের নেওয়াজ, মোহাম্মদ নাসির আলী, শওকত ওসমান, আতোয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান প্রমুখ। বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থরচনা করে আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আশরাফ সিদ্দিকী, রোকনুজ্জামান খান, মাহবুব তালুকদার, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ গদ্য ও পদ্যে শিশুতোষ সাহিত্যরচনা করেছেন। শিশুসাহিত্যে বেশ জনপ্রিয়তা পান রোকনুজ্জামান খান এবং আশরাফ সিদ্দিকী। কবি সুফিয়া কামালের ‘পল্লীস্মৃতি’ এবং ‘আজিকার শিশু’ চিরায়ত সাহিত্যে পরিণত হয়েছে ইতোমধ্যে। আলাউদ্দীন আল আজাদের গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি’ আবেগে আপ্লুত করেছে শিশুসাহিত্যের পাঠকদের।
চার
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর শিশুসাহিত্যের একটি অনবদ্য চারণভূমি হয়ে ওঠে আজকের বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান)। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর নতুন শিশু-কিশোর সাহিত্য যেমন অব্যাহতভাবে বিকশিত হয়েছে, তেমনি ছোটদের পত্রপত্রিকার প্রকাশনাও নতুনভাবে শুরু হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে ফয়েজ আহমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘হুল্লোড়’, এরপর এলো ‘শাহীন’ ও ‘সিতারা’ নামের দুটি পত্রিকা। প্রকাশিত হত ‘শিশু সওগাত’ আর ‘শিশু মোহাম্মদী’।
১৯৪৮-এর ডিসেম্বরে আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত পাক্ষিক ‘মুকুল’ পত্রিকাটি এদেশের সাতচল্লিশ-পরবর্তীকালের প্রথম ছোটদের পত্রিকা। সেই থেকে শুরু করে ১৯৭১’র স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছোটদের পত্রিকার মধ্যে ছিলÑ ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত মঈদ-উর রহমান সম্পাদিত মাসিক ‘ঝংকার’, বেগম ফওজিয়া সামাদের সম্পাদনায় ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত মাসিক ‘মিনার’, ১৯৫১ সালে তৈয়েবুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘সবুজ নিশান’, ১৯৫৪ সালে আবদুল ওয়াহেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘আলাপনী’, ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত ‘খেলাঘর’, ১৯৫৫ সালে সরদার জয়েনউদ্দীন সম্পাদিত পাক্ষিক ‘সেতারা’ ও পাক্ষিক ‘শাহীন’, আল কামাল আবদুল ওহাবের সম্পাদনায় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মাসিক ‘সবুজ সেনা’, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে জেব-উন-নিসা আহমদ সম্পাদিত মাসিক ‘খেলাঘর’, অধ্যাপক আলমগীর জলিল ও আলাউদ্দিন আল আজাদ সম্পাদিত ১৩৬৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘কিশলয়’, ১৩৬৭ থেকে ১৩৭৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত মোসলেম উদ্দিন সম্পাদিত মাসিক ‘রংধনু’। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলন এসব কিছু মিলিয়ে আমাদের শিশুসাহিত্যের ভা-ারটি বিষয়বৈচিত্র্যে ভরে উঠেছে।
ষাটের দশকে কয়েকজন কবি ও ছড়াকারও আলোড়ন তুলেছেন সমানে। তাঁদের মধ্যে সবার আগে নাম আসে সুকুমার বড়ুয়ার নাম। শিশুতোষ বিষয়ের পাশাপাশি তিনি বড়দের বিষয়কেও নিখুঁতভাবে হাজির করেছেন ছোটদের সামনে। তাঁর প্রতিটি ছড়া পড়ে যেমন আনন্দে আহøাদিত হয়েছে শিশুরা, তেমনি ভাবনার সাগরে সাঁতার কেটেছেন বড়রাও। বলা যেতে পারে ছড়াসাহিত্যের তুলতুলে ভাবকে তিনি সাবালক করে তুলেছেন। পাশাপাশি রফিকুল হক, আবু সালেহ এবং আখতার হুসেন ছড়ায় দিয়েছেন অফুরন্ত প্রাণশক্তি। ষাটের দশকে আমাদের শিশুসাহিত্য আরও উর্বর হতে থাকে ফজল-এ-খোদা, আখতার হুসেন, আল মুজাহিদী, আসাদ চৌধুরী, শামসুল ইসলাম, আলী ইমাম, আবু সালেহ, মসউদ-উশ-শহীদ, সৈয়দ শামসুল হুদা, হোসেন মীর মোশাররফ, সাজ্জাদ হোসাইন খান, শাহাবুদ্দীন নাগরী, খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, জুবাইদা গুলশান আরা, নয়ন রহমান, দিলারা মেসবাহসহ আরও অনেকের হাত ধরে। বাংলা শিশুসাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে ষাটের দশকের সাময়িক পত্রিকাসমূহ। এর মধ্যে ১৯৬২ সালে হাবীবুর রহমান সম্পাদিত মাসিক ‘পাপড়ি’, শাহেদ আলীর সম্পাদনায় ১৯৬২ সালে প্রকাশিত মাসিক ‘সবুজ পাতা’, ১৯৬৩ সালে তাছির উদ্দিন আহমদ ও সৈয়দ তাইফুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘সোনার কাঠি’, ১৯৬৪ সালে শামিম আজাদের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘নবারুণ’, ১৩৭১ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে মো. আবদুল কাদেরের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘টরেটক্কা’, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘কচি ও কাঁচা’, ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত গোলাম মোরশেদ ও নীলুফার বানু সম্পাদিত মাসিক ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম থেকে এখ্লাস উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত মাসিক ‘টাপুর টুপুর’, ১৯৭০ সালে আবদুস সাত্তারের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘নবারুণ’ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পাঁচ
সত্তর, আশি ও নব্বই এই তিন দশকে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের বাগান ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। এই তিন দশকে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের অগ্রগণ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- রোকেয়া খাতুন রুবী, মতিউর রহমান মল্লিক, আবদুল হাই শিকদার, সোলায়মান আহসান, ফারুক হোসেন, ফারুক নওয়াজ, লুৎফর রহমান রিটন, আনওয়ারুল কবীর বুলু, আমীরুল ইসলাম, আহমদ মতিউর রহমান, ইকবাল করিম রিপন, সুজন বড়–য়া, রহীম শাহ, বাপী শাহরিয়ার, টিপু কিবরিয়া, ইসমাঈল হোসেন দিনাজী, আবদুল হালিম খাঁ, আহমদ আখতার, সৈয়দ মাহবুব রেজা, আসাদ বিন হাফিজ, দিলওয়ার বিন রশিদ, শরীফ আবদুল গোফরান, নাসির হেলাল, মহিউদ্দিন আকবর প্রমুখ। ষাটের দশকের চেয়ে পরবর্তী দশকগুলোতে, এমনকি বর্তমানেও অনেক বেশি উজ্জ্বল মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিশুসাহিত্য চর্চার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রায় ৪২৪টি শিশু-কিশোর উপযোগী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। পাঁচ খ-ে প্রকাশিত শিশু-বিশ্বকোষ (১৯৯৩-৯৮) শিশু একাডেমির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এই প্রতিষ্ঠানের মাসিক পত্রিকা ‘শিশু’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের ছোটোদের পত্রিকার মধ্যে ড. মাযহারুল ইসলামের সম্পাদনায় ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘ধানশালিকের দেশ’, জোবেদা খানমের সম্পাদনায় ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত মাসিক ‘শিশু’, মাসুদ আলীর সম্পাদনায় ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত মাসিক ‘ফুলকুঁড়ি’, ১৯৭৬-১৯৮৩ পর্যন্ত প্রকাশিত নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ ও আহমদ জামান চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশের একমাত্র ছোটোদের সাপ্তাহিক ‘কিশোরবাংলা’, ১৯৭৮ সালে জ্যোতির্ময় মল্লিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কুটুমপাখি’। বাংলাদেশে উৎকৃষ্টমানের সুসম্পাদিত আরও বেশ কিছু শিশুকিশোর সাহিত্য পত্রিকা হলো ‘নবারুণ’, ‘রংধনু’, ‘কিশোরজগত’, ‘কিশোর পত্রিকা’, ‘কিশোর
তারকালোক’, ‘ছোটদের কাগজ’, ‘দুরন্ত’, ‘মৌলিক’ ও ‘সাতরং’।
শিশুসাহিত্যে চট্টগ্রামের রয়েছে বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য উত্তরাধিকার। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চট্টগ্রাম হল বর্মি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি , আরব বণিক, ইংরেজ প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মিলনক্ষেত্র। প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ছিল শিল্প-সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের চারণভূমি। আর আরাকান রাজ্য ঘিরে মধ্যযুগে এতদঞ্চলে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। বিভিন্ন ধর্মবর্ণ ও জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ চট্টগ্রামের লোকসংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যের অনবদ্য ভা-ারে পরিণত করেছে। বাংলা ভাষার আদিনিদর্শন ‘চর্যাপদের’ অনেক চর্যাকারের জন্মজনপদ ও সাধনপীঠও ছিল এই চট্টগ্রাম।
বাংলা শিশুসাহিত্যে চট্টগ্রামের যেসব লেখকের অনবদ্য অবদান রয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ছড়াসম্রাট সুকুমার বড়ুয়া, অজয় দাশগুপ্ত, আলেক্স আলীম, সন্তোষ বড়–য়া, রাশেদ রউফ, ওমর কায়সার, রমজান আলী মামুন, উৎপল কান্তি বড়–য়া, বিপুল বড়–য়া প্রমুখ। শিশুসাহিত্যকে ঋদ্ধ করতে তরুণদের ভূমিকা অপরিসীম। শিশুসাহিত্যের ক্যানভাস বাংলাদেশের লেখকদের ক্ষুরধার লেখনিতে আরো শাণিত হোক, সমৃদ্ধ হোক আর বিশ্বসাহিত্য দরবারে বাংলা শিশুসাহিত্য আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হোক।