আবদুল মান্নান »
১৯৭০ এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ১৬৯টি আসনের ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের গণপরিষদের মোট আসন ছিল তিনশ। এটি স্বাভাবিক ছিল যে আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করবে আর শেখ মুজিব হবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। চালু হলো পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের ষড়যন্ত্র। সঙ্গে যোগ দিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টো। তাঁর দল সত্তরের নির্বাচনে পেয়েছিল ৮১টি আসন।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংঘাত অনিবার্য। তবে এই সংঘাত সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবার দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ। ২৩ বছর তো অপেক্ষা করেছে বাঙালি। এই ২৩ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে নিরন্তর শোষিতই হয়েছে। বাস্তবে পূর্ব বাংলা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ। ১৯৭০ এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে প্রথম গুলিটা ছুঁড়লো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শুরু হলো নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। শুরু থেকেই পাকিস্তানি দালালরা ছাড়া নিরস্ত্র শান্তিকামি বাঙালি হয়ে উঠলো একটি সশস্ত্র জাতি। পাশে পেল অনেক বন্ধুপ্রতিম দেশ যাদের মধ্যে ভারত আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যতম। তারা পাশে এসে দাঁড়ালো সব ধরনের সহায়তা নিয়ে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বন্দি হলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে। তাঁকে সামনে রেখেই বাংলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধ চালিয়ে গেল। ১০ এপ্রিল হয়েছিল প্রবাসী সরকার যার অন্যতম সদস্য ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবন রাজনৈতিক সহচর খোন্দকার মোশতাক যিনি পরবর্তিকালে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কারিগর হিসেবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সঙ্গে খোন্দকার মোশতাকের আগে দোসরদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কতিপয় সেনা কর্মকর্তা যারা মুক্তিযুদ্ধের একেবারেই শেষ সময়ে এসে প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ধারণা করা হয় তাদের পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রের কথা গোড়া থেকেই অবহিত ছিলেন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল জিয়া যিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ক্ষমতা দখল করে পনেরই আগস্টের হত্যার দায়মুক্তি দিয়ে তাদের বিদেশে দূতাবাসে পদায়ন করেছিলেন। সেনা ছাউনিতে গঠন করেছিলেন বিএনপি।
১৯৯১ সালে বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে জাতীয় সংসদে খোন্দকার মোশতাকের জন্য শোক প্রস্তাব পাশ করিয়েছিলেন। অনেকে প্রশ্ন করেন বঙ্গবন্ধু কি তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে জানতেন না? জানতেন হয়তো, তবে তা তিনি বিশ্বাস করেননি। তাঁকে বিভিন্ন মহল থেকে বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ একাধিকবার সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল, বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করেননি। আরো একটি ভুল হয়তো বঙ্গবন্ধু করেছিলেন আর তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কার কী ভূমিকা ছিল তা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত না হওয়া।
বঙ্গবন্ধু ২৩ বছরের পাকিস্তানে বাঙালির স্বার্থ আদায়ের জন্য প্রায় ১৩ বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু দেশকে একটি অত্যাধুনিক সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন যার ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়া ক্ষমতা দখল করে সবার আগে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করার কাজটি করলেন। বঙ্গবন্ধু ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। নিষিদ্ধ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সব রাজনৈতিক দলকে। জিয়া এই সব নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে বিধৌত বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি ফিরিয়ে আনলেন। তিনি পাকিস্তান যে একাত্তরে বাংলাদেশকে দখল করেছিল আর মুক্তিযোদ্ধারা তা মুক্ত করতে যুদ্ধ গিয়েছিল তা ভুলিয়ে দেয়ার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর পরিবর্তে ব্যবহার করেন দখলদার বাহিনী শব্দ দুটি। এই ইতিহাস নিয়েই বাংলাদেশের অন্তত তিনটি প্রজš§ বেড়ে উঠেছে। তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানা থেকে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ২১ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে ছিল। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসে ইতিহাসের গতিটাকে আবার সামনের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা শুরু করেন। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না কারণ এই দীর্ঘ সময়ে দেশে যে প্রশাসন গড়ে উঠেছে তা অনেকটা পাকিস্তানি ধাঁচের। মাঝখানে ২০০১ সালে যখন বেগম জিয়া ক্ষমতায় আসেন এরপর এক এগারোর দুই বছর আবার ছন্দ পতন । ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ফের রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে চেষ্টা করেছেন দেশকে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু পথে পথে বাধাতো আছেই। বাধা আছে ঘরের ভিতর। বাধা আছে বাইরে। এরই মধ্যে যারা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন তারা এখন নানা নামে একত্রিত হচ্ছেন । সাথে আছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তারা । লক্ষ্য যে কোন উপায়ে সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার সরকারের বিরোধিতার নামে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা ।
বঙ্গবন্ধু কন্যাকে কখনো কখনো মনে হয় তিনি একজন নিঃসঙ্গ শেরপা। তাঁর চার পাশে মানুষ আছে অনেক কিন্তু ক’জন আছেন তাঁর বিশ্বস্ত? বঙ্গবন্ধুর চারপাশেও মানুষের ঘাটতি ছিলনা । তাদের প্রায় সকলে বঙ্গবন্ধুর লাশকে তাঁর ধানমন্ডির বাসবভনের সিঁড়িতে ত্রিশ ঘণ্টা রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন । বাদ ছিলেন জাতীয় চার নেতা । তাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের বিশ্বাস ও আনুগত্যের প্রমাণ রেখে গিয়েছেন। এতকিছুর পরও বঙ্গবন্ধু কন্যা অসাধ্যকে সাধন করার চেষ্টা করছেন। তিনি ক’দিন আগে বলেছেন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাঁর এই ধারণা অমূলক নাও হতে পারে কারণ যারা পঁচাত্তরে তাঁকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল তারা আবার শেখ হাসিনাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে । বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তারাতো তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে রাখঢাক করে না। প্রায়ই স্লোগান দেয় ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আর একবার’। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্বে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে এগিয়ে এসেছিল কয়েকটি প্রিন্ট মিডিয়া। এই মুহূর্তে ঠিক এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে একাধিক মিডিয়া আর সংগঠন । তাদের কথা শুনলে বা পড়লে মনে হতে পারে বাংলাদেশের সকল মুশকিলের অবসান হয়ে যাবে একজন শেখ হাসিনাকে হঠাতে পারলে। তবে এই মুহূর্তে নির্মোহ ভাবে চিন্তা করলে বলতে হয় শেখ হাসিনাই বাংলাদেশের শেষ বাতিঘর। তাঁর ভুল ত্রুটি থাকতেই পারে । তিনিতো আর ফেরেশতা নন । তবে তাঁকে হয়তো আরো সাবধানী হতে হবে । দূরে থাকতে হবে ওই সব মানুষ থেকে যারা চারিদিকের ঘটে যাওয়া সত্যটা তাঁর কাছ থেকে আড়াল করে তিনি যা শুনে খুশি হবেন তাই তাঁকে শোনান । এরাই হতে পারেন সব শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় শত্রু।
বেঁচে থাকুন বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যন, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন