নিজস্ব প্রতিবেদক »
ছোট্ট কুঁড়েঘরের উঠানে দাঁড়িয়ে ফেসবুকে ছেলের ভাইরাল হওয়ার ছবির সাথে ৭ বছর আগের ছবি মিলিয়ে দেখছেন আমেনা খাতুন। আশেপাশের লোকজনের চোখে সন্দেহ্লÑদলে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি জয়নাল নয়। কিন্তু মায়ের চোখ কখনো ভুল হয় না। মা চিনেছে নিজের ধনকে। চোখ, কান, নাক প্রতিটি অঙ্গই তার চেনা। আট বছর পরেও ফেসবুকে ছবিটি থেকে ঠিকই চিনে নিয়েছেন তার ছেলেকে। ২০১৩ সালে যে ছেলেটা মানবপাচারকারীর কবলে পড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল সেই জয়নাল এখনো বেঁচে আছে পৃথিবীতে।
ছেলে হারানোর কষ্ট পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিলের এতদিন। মিথ্যা সান্ত¦না দিয়ে প্রতিটি ক্ষণ পাড়ি দিয়েছেন। ভেবেছিলেন ছেলে বেঁচে নেই। একটি ছবিই ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা জাগিয়ে তুললো।
ফেসবুকে ছেলের ছবি দেখতেই আমেনা খাতুন কান্নায় ভেঙে পড়েন। চারপাশের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে আকুতি, অনুনয়, বিনয়, অনুরোধ-যেন তার ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। চারপাশ কান্নার রোল তুলে বলতে ঘোষণা করতে থাকে-যে ছেলেকে ফিরিয়ে দিবে, তার সারাজীবন গোলামি করবে।
ছবিতে সবুজ গেঞ্জি পরা ২০-২৫ জন তরুণকে বসা অবস্থায় দেখা যায়। পিছনে দাঁড়ানো টুপি পরিহিত এক ছেলেকে নিজের সন্তান উল্লেখ করে আমেনা খাতুন বলেন, ‘আপনারা সাংবাদিক। আপনারা চাইলে অনেক কিছু করতে পারেন। টুপি দেওয়া এটা (জয়নাল) আমার ছেলে। আপনারা আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন।’
সম্প্রতি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মালয়েশিয়ার জেলে বন্দি থাকা বাংলাদেশি কিছু নাগরিকের কয়েকটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ছবিগুলো এএনডিপি (আরাকান ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি পার্টি) নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে পোস্ট করা হয়। সেখানে মোহাম্মদ শরীফের আইডি থেকে শেয়ারকৃত ছবিগুলো এই পেজে তুলে ধরা হয়।
মোহাম্মদ শরীফের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেল, এই ছবিগুলো মালয়েশিয়ার জেলখানার। জেলখানারগুলোর নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিক্স প্লাটিন ক্যাম্প (ঝরী চষধহঃরহ ঈধসঢ়), কালামপুর (কধষঁস চঁৎ), সোনকাকা ক্যাম্প (ঝড়হধ কধশধ ঈধসঢ়)।
বন্দিদের মুক্তির জন্য তিনি এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্রুতবাস ও মালয়েশিয়ার দ্রুতবাসের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
পোস্টে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, মানবাধিকার কর্মী ও মালয়েশিয়ার সরকারে কাছে অনুরোধ, দ্রুত যেন এই নিষ্পাপ ছেলেদের মুক্তি দেয়া হয়। তাদের যেন তাদের মা-বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ছেলে হারানোর ক্ষণ
জয়নাল আবেদিনের বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যাংছড়ি থানার সোনাইছড়ির নন্নাকাটা গ্রামে। মানবপাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে জয়নাল আবেদিনকে কক্সবাজার উপকূল দিয়ে ট্রলারে তুলে দেয়। এরপর থেকে নিখোঁজ। ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবরে ঘটনা। দিনটি ছিল রোববার। দুপুরে মা-বোনকে কিছু না জানিয়ে মালেশিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন জয়নাল। হয়তো স্বপ্ন ছিল সুদিনের। পরিবারের অর্থ কষ্ট দূর করে সুন্দর দিনের আশায় সাগর পথে পাড়ি দিয়েছেন মালয়েশিয়ায়।
চার ভাই বোনের মধ্যে জয়নাল ছিল সবার বড়। জয়নালের ছোট বোন সুমি আক্তার ধীর কণ্ঠে বলেন, ২০১৩ সালে ৮ অক্টোবর ভাই বাড়ি থেকে চলে যায়। তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। ভাই যেদিন চলে গিয়েছিল স্কুলে ছিলাম। সেদিনের পর থেকে ভাইয়ের আর দেখা পাইনি।
জয়নাল আবেদিনের মা আমেনা বেগম বলেন, ‘প্রথম যেদিন ছেলে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছিল আমাদের কিছু বলেনি। একদিন পর রাতে ফোন করে বললো ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় যাচ্ছি। আমি তো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেকে জিজ্ঞেসা করলাম, এভাবে কী মালয়েশিয়া যাওয়া যায়? জয়নাল কোন উত্তর দিতে পারেনি।
আমেনার কথা অস্পষ্ট হয়ে গেল। কণ্ঠস্বর ধরে এল। চোখ দুইটি জলে ভরে উঠলো। আঁচলে চোখ মুছে আবারও বলা শুরু করলো। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার ৪ দিন পর ফোন করেছে। ফোন করে ছেলে বললো, সে বোটে (ট্রলার) উঠে যাচ্ছে। জানতে চাইলাম, বোটে কে নিয়ে গেছে? বলেছে, দালালে নিয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর দালাল আবার ফোন করেছে। বলেছে, জয়নাল মালয়েশিয়া পৌঁছে যাচ্ছে। আড়াই লাখ টাকা দিতে হবে। দিতে না পারলে ছেলে পাওয়া যাবে না।
কত টাকা চেয়েছে? বললো, আড়াই লাখ টাকা পাঠাতে। এ কথা শুনে আমি পাগল হয়ে গেছি। গোয়ালে ৭টি গরু ছিল। গরুগুলো শুধু ৮০ হাজার টাকা দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছি। জমি ছিল-বর্গা দিয়েছি। এভাবে দেড় লাখ টাকা জোগাড় করেছি।
টাকা কিভাবে, কাকে দিয়েছেন, জানতে চাইলে আমেনা বলেন, ‘দালালকে দিয়েছি। দালালের নাম আমান উল্লাহ। তার বাবার নাম ফরিদ। ওদের বাড়ি আমাদের এখানে। ফরিদ এবং ফরিদের ভাই আমার বাড়িতে এসে টাকা নিয়ে গেছে। টাকা দেওয়ার পর থেকে ওদের আর দেখা পাইনি। ফোনে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। এখনো আমার ছেলেকেও পাইনি।’
সেইদিন থেকে এখনো নিখোঁজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে হয়তো আশাটুকু জেগে আছে। ছেলে এখনো আছে-এই সান্ত¦নাটুকু যেন সত্যি হয়।
এ মুহূর্তের সংবাদ