রাজিব শর্মা »
নগরের বিভিন্নস্থানে ফুটপাত দখল করে দোকানের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা। বেশিরভাগ ফুটপাতে হাঁটার কোনো সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সামনের ফুটপাত ও হাসপাতালের গেটসহ দখল করে কম্বল বিক্রি করার দৃশ্য চোখে পড়ে। এ নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় হাসপাতালগামী স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী, তাদের স্বজন ও পথচারীদের। জেনারেল হাসপাতালের গেটের সামনে বসা কম্বলের দোকানদার শাহীন আলম সুপ্রভাতকে বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বসতে নিষেধ করেছে। সমিতির মাধ্যমে আমরা বসি।
একই স্থানের আরেক ভ্রাম্যমাণ কম্বলের দোকানদার রুপক চন্দ্র দাশ বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের অনেকবার উঠিয়ে দিয়েছে। আমরা যাবো কোথায়। আমাদের যদি কোথাও বসার স্থান ঠিক করে দেয়া হয় তাহলে এখানে আর বসবো না।
নগরীর স্থানীয়দের অভিযোগ, হকাররা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও ক্ষমতাশালীদের ম্যানেজ করে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কমিশনার জহরলাল হাজারি বলেন, ‘আন্দরকিল্লা রোডটি নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। শুধু ফুটপাত না, গাড়ি চলাচলের রাস্তাও দখলকরে ফেলেছে হকাররা। এসব ফুটপাত দখলে হকারদের সাথে ব্যবসায়ীরাও জড়িত। তারা পাঁচশ-একহাজার টাকা নিয়ে উপ-ভাড়াটিয়া বসায়। এখানে হকাররা আবার বিভিন্ন সংগঠন করে। তাদের সংগঠনের সাথে প্রভাবশালীরা জড়িত থাকে। তাদের মধ্যেআর্থিক লেনদেন ভাগ-বাটোয়ারা হয়। প্রশাসনের দ্রুত জামালখান, আন্দরকিল্লা ও পাথরঘাটায় যৌথভাবে অভিযান চালানো দরকার। না হয় এদের উচ্ছেদ করা কঠিন হবে।’
আন্দরকিল্লা মোড়ের বই ব্যবসায়ী রফিকুল আনোয়ার বলেন, ‘হকার্স মালিক সমিতিকে অর্থ দেয়ার বিনিময়ে এখানে দোকানগুলো বসে। এমনকি হাসপাতাল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলেও তার সামনে কম্বল ও পোশাক ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে। এতে জেনারেল হাসপাতালের বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড তাদের থেকে ভাড়া নেয়। এভাবে দখল-বেদখল আর ম্যানেজে ফুটপাত আর রাস্তায় বসে কাঁচাবাজারও।’
আন্দরকিল্লা মোড়ে গত রোববার রাত ৯টায় ভ্যানগাড়ি নিয়ে ফুটপাতে সবজি বিক্রি করছিলেন এক ব্যক্তি। ব্যবসা করতে কাউকে চাঁদা দিতে হয় কিনা, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখানে হকার্স মালিক কমিটির লোক দাবি করে একজন ৫০ টাকা নিয়ে গেছে। হকারদের নানা গ্রুপ আছে। এক গ্রুপ টাকা নিয়ে গেলে আরেক গ্রুপ আসে। এক গ্রুপকে ২০ থেকে ৫০ টাকা দিয়ে বিদায় করতে হয়।’
হকারদের চাঁদা আদায়ের বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে, টেরিবাজার-আন্দরকিল্লা হকার্স মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকমো. লোকমান হাকিম বলেন, ‘এরা গরিব, যাবে কোথায়? দু’পয়সা আয় না করলে তো বেকার হয়ে যাবে।’
দৈনিক চাঁদার বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা দশ-বিশ টাকা নেই। তা আবার হকারদের বিপদে আমরা ব্যয় করি। তাদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে, সন্তানদের শিক্ষার খরচ চালানো ইত্যা দিতে ব্যয় করি। কোন হকার টাকা না দিলে জোর করি না।’
হাসপাতালের সামনের এলাকা জেনারেল হাসপাতালের আওতায় নেই মন্তব্য করেন জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ফজলে রাব্বী। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘বিকালের পর থেকে জায়গাটা সাধারণত আমাদের আওতার মধ্যে না থাকার কারণে আমরা কিছু করতে পারি না। ইমার্জেন্সি বিভাগের সামনে যেন কেউ না বসে তা আমরা খেয়াল রাখি। কিন্তু একটি হাসপাতালের সামনে এভাবে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসার বিষয়টি নিয়ে চসিকের মাথাব্যথা নেই।’
অন্যদিকে নগরের বিআরটিসি মোড় থেকে নিউমার্কেট ও লালদীঘিগামী সড়কের এক পাশের বড় একটা অংশ খেলনা, মেট্রেস, জামা-কাপড়ের ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। অন্য পাশে পর্যটন মোটেল পর্যন্ত চোরাইপণ্যের রমরমা ব্যবসা আর বাকি অংশ মাদকসেবীদের রম্যভুবন।
পুরাতন রেল স্টেশন চত্বর থেকে ফলম-ি পর্যন্ত প্রকাশ্যেই চলে মাদক বেচাকেনা আর অবাধ সেবন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ড কমিশনার হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘এ সমস্যা শুধু আমার ওর্য়াডে না, পুরো নগরের ফুটপাত ও রাস্তা হকারদের দখলে চলে যাচ্ছে। আমরা একবার উচ্ছেদ করলে পরদিন আবারো এসে বসে।’
এদিকে বাকলিয়ার কর্ণফুলী ব্রিজ থেকে ওমর আলী মার্কেটের সামনে পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ দোকানদারদের দখলে রাস্তাঘাট। এমনকি চাক্তাই ব্রিজেই বসে শাকসবজি ও মাংসের দোকান। সঙ্গে থ্রি-হুইলার্স ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার পার্কিং। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দুষছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্রশাসনের অবহেলাকে।
এ বিষয়ে বক্সিরহাট ওর্য়াড কাউন্সিলর হাজি নূরুল হক, বলেন, ‘আমি গত ১ তারিখও নিজ উদ্যোগে অভিযান চালিয়েছি। কিন্তু আমাদের কথা হকাররা মানছে না। তাদের পেছনে শক্তিশালী মহল কাজ করছে। এখানে তারা দৈনিক আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে হকারদের বসায়। আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি। এ বিষয়ে চসিক জোরালো পদক্ষেপ না নিলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।’
কদমতলী এলাকায় সহজেই পাওয়া যায় যানবাহনের ইঞ্জিনসহ খুচরা যন্ত্রাংশ। সেখানে ব্যবসায়ীরা ফুটপাত দখলের পর রাস্তার অন্তত ১০ ফুট দখল করে যন্ত্রাংশ সাজিয়ে-বিছিয়ে রেখেছেন। এখানে মোটরসাইকেল মেরামতকারীদের দখলে থাকে রাস্তার বিশাল একটা অংশ। লালদিঘি অংশে রাস্তার দুই পাশে সব সময়ই দাঁড়িয়ে থাকে কার ও মাইক্রোবাস। এসব গাড়ি সেখান থেকে নানা জায়গায় ভাড়ায় যায়। লালদীঘি এলাকার ফুটপাতও হকারের দখলে।
এ বিষয়ে জানতে সিটি করপোরেশনের মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, প্রধান পরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্ট কমকর্তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
চসিকের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. নূর উদ্দিনের কাছে নগরীর ফুটপাত দখল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি দেখাশোনা করে পরিচ্ছন্ন বিভাগ। চসিক থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয়, কিন্তু ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা আবারও বসে যায়।’
নগরবাসীদের কেউ কেউ নগর পরিকল্পনা বিভাগের ব্যর্থতা ও দীর্ঘসূত্রতা বলে মনে করছেন এ বিষয়টি কিভাবে দেখছেন এর জবাবে তিনি বলেন, ‘চসিকের নগর পরিকল্পনা বিভাগের কেউ দায়িত্বে অবহেলা করে না। তবে এখানে নগর পরিকল্পনা বিভাগ বলতে কিছু নেই। বিভিন্ন প্রকল্প প্রকৌশল বিভাগ বাস্তবায়ন করে।’
চসিকের উপপ্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কিছুদিন আগে মেয়র ও বেশ কয়েকজন কাউন্সিলরসহ বৈঠকে বসেছিলাম। এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমাদের উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। তবে এগুলো উচ্ছেদ করতে হলে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা প্রয়োজন হয়। চসিক তো আর একা পারে না। এখানে হকারদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট আছে। অনেক সময় উচ্ছেদ করতে গিয়ে আমাদের বিভিন্ন ঘটনার মুখোমুখিও হতে হয়। তবুও আমরা নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে যাবো।