পেঁয়াজি

সাকিব ইকরাম :

মামা খিদে পেয়েছে।

খাতুনগঞ্জের যে অফিসে আমি চাকরি করি ওটার নিচে একটি রকমারি খাদ্যের দোকান আছে। দুপুরের খাবারের পর মাঝেমধ্যে দুএকজন সহকর্মী নিয়ে ওখানটায় প্রায়শ ঢুঁ মারি। দোকানের বাহারি রঙের  ফালুদা আমার বেশ পছন্দের। যদিও মিষ্টি একটু বেশি পরিমাণে থাকে। তারপরও বলব বেশ ভালো। ফালুদার এক চামচ মুখে দিতেই তার গলার আওয়াজ কানে এসে লাগল।

আরে তুই! একি! আবার কি কেউ তোকে মেরেছে রে!

মেয়েটির চুল উসখোখুসকো। গলায় খামচির দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।  সে দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। দোকানদার ধমক দেয়, এই যাহ!

আমি বললাম, থামুন তো। ও আমার অতিথি। আমি ওকে খাওয়াবো।  দোকানদার আমার দিকে আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়।

আয়। ভেতরে আয়।

ও কে?

সহকর্মী একটু আশ্চর্য হন। আমি বললাম ও হল পেঁয়াজি। এখানে ট্রাক  থেকে পেঁয়াজ নামানোর সময় দু-একটা এদিক-সেদিক পড়ে যায়। ওরা কুড়িয়ে নিয়ে বিক্রি করে।

আচ্ছা! সহকর্মী আরেকটু আশ্চর্য হন।

পেঁয়াজ কুড়াতে গিয়ে ওদের মধ্যে ঠোকাঠুকি হয়। এমনকি ওরা একজন আরেকজনকে জখম পর্যন্ত করে। ওই যে দেখেন ওর গলার নিচে খামচির দাগ।

ওর সাথে পরিচয় কেমনে? সহকর্মীর প্রশ্ন।

সে কাহিনি বলছি। আগে ওকে কিছু খাওয়াই।

কি খেতে চাস, বল তো।

সে পেটিস খেতে চাইলে দোকানদারকে দিতে বলি।

আমি সহকর্মীর দিকে ফিরে বসলাম।

সেদিন সকাল বেলা। অফিসে ঢুকতে নিশ্চিত লেট হবে ভেবে জ্যামে রিকশা থেকে নেমে অনেকটা দৌড়াচ্ছিলাম। দেখি কয়েকজনের জটলা। একটা মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। গিয়ে দেখি মেয়েটির মাথা বেয়ে রক্ত ঝরছে। আশেপাশের সবাই দাঁড়িয়ে হাউকাউ করছে শুধু। জানলাম পেঁয়াজ কুড়াতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে মাথায় আঘাত পেয়েছে। ভাবলাম, অফিসে লেট হলে হোক। আগে ওকে ডাক্তার দেখাই। কাছেই  হাসপাতাল। তিনটে সেলাই পড়েছে মাথায়। সেই থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। পেঁয়াজ কুড়ায় বলে তাকে আমি পেঁয়াজি ডাকি।

পেঁয়াজি পেটিস খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  বললাম, দাঁড়িয়ে আছিস যে!

জামাইল¬ার জন্য একটা নেব। জামাল তার ছোটভাই। এতটুকুন একটা  মেয়ে ভ্রাতৃস্নেহে কাতর।

নে।

আমার মা বলে, ছোট ছেলেমেয়েরা নিষ্পাপ। ফেরেশতার মতো। তাদেরকে খুশি করলে আল্লাহ খুশি হন। মায়ের কথাটা মনে পড়ল।

বলেছিলাম পেঁয়াজি নামটা আমারই দেয়া। তার আসল নাম হাবিবা কিংবা এ রকম কিছু একটা। ঠিক মনে পড়ছে না। চাক্তাই খাল পাড়ের ঝুপড়িতে থাকে। হাসপাতাল থেকে মাথার ব্যান্ডেজ সেরে ওখানে দিয়ে এসেছিলাম সেদিন। তার মায়ের সাথে কথা বলে জেনেছিলাম, ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করে অন্য জায়গায় চলে গেছে। তাদের খোঁজখবর নেয় না। মা বিভিন্ন বাসায় ছুটা কাজ করে। জীবনধারণের জন্য কিছু দায়িত্ব এই বয়সে তাই তার কাঁধেও এসে পড়েছে। সারাদিন পেঁয়াজ কুড়িয়ে যা জুটে তা পাশের বউবাজারে বিক্রি করে যৎসামান্য যা পায় আর বাসাবাড়ির কাজ থেকে মায়ের আয় দিয়ে কোনো মতে দিন চলে।

অফিসে আসার পথে মাঝেমধ্যে তার সাথে দেখা হয়ে যায়। দৌড়ে এসে মামা ডেকে সালাম দেয়। এ আচরণ সে কোত্থেকে শিখল! আমি মাথায় আঙুলের টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করি, কিরে আজকে কেমন পেলি।

কাজে ব্যস্ত থাকায় পেঁয়াজির কথা মনেই ছিল না। মনে রাখার বিশেষ কোনো কারণও নেই। হঠাৎ মনে হল তাকে অনেকদিন দেখছি না তো। ভাবলাম, অফিস থেকে বের হবার পথে আজকে তার একবার খোঁজ  নেব। বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে ঝুপড়ির সামনে পৌঁছাতে তার মা বের হয়ে আসে। মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে  কেঁদে ওঠে। যা শুনলাম তা শোনার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। ট্রাকের ধাক্কা লেগে দুদিন হাসপাতালে ছিল, ততীয় দিন পেঁয়াজি মারা গেছে। পাশে মসজিদের গোরস্তানে কবর দেয়া হয়েছে। আমি বাকরুদ্ধ!

ওখান থেকে বের হয়ে কবরস্থানের দিকে হাঁটতে থাকি। হ্যাঁ, এটাই তো তার কবর! আর কোনো নতুন কবর দেখছি না। একেবারে তার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। পেঁয়াজি! পেঁয়াজি! তুই শুয়ে আছিস!

চোখ ভিজে ওঠে। আমার কান্না পাচ্ছে কেন!

আচ্ছা, তুই কি আমার কেউ ছিলি রে মেয়ে?