পাহাড়ধস ঠেকাতে নেয়া হয়নি টেকসই পরিকল্পনা

৭২ ঘণ্টায় ধস চার পাহাড়ে

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া »

বিশ্বকলোনি কাঁচাবাজার এলাকায় সর্বশেষ ৭২ ঘণ্টায় তিনটি ও টাইগারপাস এলাকায় একটি পাহাড়ে ধস হয়। বৃহস্পতিবার রাত থেকে থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা বৃষ্টি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুক্রবার সকালে টাইগারপাস ও বিশ্বকলোনি কাঁচাবাজার এলাকায় দুটি পৃথক পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এরপর শনিবার সন্ধ্যায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরতদের সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায় জেলা প্রশাসন।
পাহাড়ধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর ২০০৭ সালে গঠন করা হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। ১৪ বছরে পাহাড় সংরক্ষণে এ কমিটি ২৭টি সভা করে। এতে নির্বাচন করা হয় ২৬টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়।
কিন্তু এসব এলাকায় এ কমিটির কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। পাহাড়ধস ঠেকাতে বা অবৈধ দখল এড়াতে কমিটি কোনো টেকসই পরিকল্পনা নেয়নি। এতে ক্ষোভ সংশ্লিষ্টদের।
জেলা প্রশাসন আকবরশাহের বিজয় নগর, শান্তিনগর, বেলতলী ঘোনা, ফিরোজ শাহের ১, ২, ও ৩ নম্বর ঝিল থেকে ৫০০ পরিবার এবং লালখান বাজারের মতিঝর্ণা থেকে ৩০০ পরিবারকে সরিয়ে নেয়। তবে বিশ্বকলোনি কাঁচাবাজার এলাকায় রোববার দুপুর পর্যন্ত অবৈধ দখলে থাকা পাহাড়ের পাদদেশের কাউকে সরানো হয়নি। এরমধ্যে রোববার সকালে কাঁচাবাজারের জি-ব্লকে শুক্রবার ধস হওয়া পাহাড়ের পশ্চিম ও পূর্ব পাশের দুটি পাহাড় ধসে পড়ে। ধসের প্রায় আট ঘণ্টা পরে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের সরে যেতে নির্দেশনা দেয় জেলা প্রশাসন।
এ নিয়ে বিশ্বকলোনি কাঁচাবাজার এলাকার বাসিন্দা নিজাম বলেন, ‘আজ (রোববার) সকাল পৌঁনে ৯টার দিকে কলসি বিল্ডিংয়ের পশ্চিমের পাহাড়ে একটি গাছসহ কিছু মাটি ধসে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পরেই একদিন আগের (শুক্রবার) ধসে যাওয়া পাহাড়টির পাশের পাহাড় ধসে পড়ে। এ ঘটনায় কোনো হতাহত না থাকলেও কখন কি হয়, তা বলা যাচ্ছে না।’
রোববার বেলা ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, ধসে পড়া মাটি সরাতে ব্যস্ত কিছু লোকজন পুরো জায়গাটি ঢেকে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও বলা সম্ভব হয়নি। গত শুক্রবারের চেয়ে রোববার সকালের ধসের পরিমাণ বেশি। আর সেই এলাকায় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের প্লটের বাইরে অবৈধভাবে বসবাস করছেন কয়েক শত পরিবার। টানা দুইবার পাহাড় ধসের ঘটনার পরও পাহাড়ের চূড়ায় বসবাস করছেন একটি পরিবার।
স্থানীয় মনির নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘প্রশাসন ফিরোজশাহতে অভিযান হয়েছে। কিন্তু কাঁচাবাজারে এতো বসতি ও দুইবার পাহাড়ধসের পরও কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি। জায়গাটা একটু ভেতরে বলে কারো তেমন মাথাব্যথা দেখছি না। কিন্তু ধসে যদি কারো মৃত্যু হতো, তখন হয়তো খবর হতো।’
এ বিষয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক ও বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে যারা বসবাস করছে, তাদের নিরাপদে সরিয়ে আনা হচ্ছে। এজন্য জেলা প্রশাসনসহ স্থানীয় প্রশাসন, কাউন্সিলর, উপজেলা পর্যায়ে চেয়ারম্যান, রেড ক্রিসেন্টসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে। টানা বৃষ্টি যেভাবে হচ্ছে, কখন কি হয় তা বলা যায় না। তাই আমরা চেষ্টা করছি, কারো যেন কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়।’
পাহাড় সংরক্ষণে অবৈধ দখলমুক্ত করতে ২৬তম সভায় বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা বলা হয়। এ কাজের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমিতো কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি আমি পরিষ্কারভাবে বলতে পারবো না। এরমধ্যে শহরের বিভিন্ন বিষয়সহ বর্তমান সংকট জলাবদ্ধতা নিয়ে সভা করেছি। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির আগামী মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো।’
২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিনের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সুপারিশে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্যসচিব করে গঠন করা হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এ পর্যন্ত এ কমিটি ২৭টি সভা করেছে। সভায় পাহাড় সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে বেশকিছু কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও কার্যত কোনো ফল পাওয়া যায়নি। এ কমিটি ২০২১ সালে নগরে ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের কথা উল্লেখ হলেও ২০২২ সালে তা বেড়ে ২৬টি করা হয়েছে। এ পাহাড়গুলোতে ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবারের বসতি বলে জানা যায়।
২০০৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাহাড়ধসের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওইদিন ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ভারি বর্ষণে বৃষ্টিতে লেডিস ক্লাব, শহরের কুসুমবাগ, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, মতিঝর্ণা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ভোরে অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড় ধসে নারী-শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট নগরীর লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিল পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড়ধসে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে দুইজন, ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে তিনজন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মা-মেয়ে, ২০২২ সালে ১৭ ও ১৮ জুন পাহাড়ধসে নিহত হয় আরও চার জনের মৃত্যু হয়। সর্বশেষ ঘটনায় নগরীর আকবর শাহ থানাধীন ১ নম্বর ঝিলে ২০২২ সালের ১৭ জুন রাত ২টায় দুই বোন এবং ১৮ জুন ভোর ৪টায় বিশ্বকলোনি লেকসিটির পূর্বে বিজয়নগরে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়।
পাহাড়ধস নিয়ে কথা হলে নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির মূলত কাজ হলো বর্ষা হলে একটা আর বিপর্যয় হলে দুটো সভা করা। এরা কাজ বলতে বুঝে শুধু উচ্ছেদ। না হয়, ১৫ বছরে এ কমিটির নেওয়া সিদ্ধান্তের কি কি কার্যকর হয়েছে তা দেখাতে বলেন। পুনর্বাসন নিশ্চিত করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকা মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করা ঠিক নয়। পুনর্বাসন না পেলে উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলো এক পাহাড় ছেড়ে অন্য পাহাড়ে বসতি গড়বে। এতে একটি পাহাড়ের জায়গায় দুই বা ততোধিক পাহাড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া চট্টগ্রামে পাহাড়গুলোর মালিকানা যাদের আছে, তাদের প্রয়োজনে সরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে পাহাড় সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।
উল্লেখ্য, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো হলো- রেলওয়ের লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮৮ পরিবার, পূর্ব ফিরোজ শাহ ১ নাম্বার ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে ৭৭৪ পরিবার এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিনাকানাধীন কৈবল্যধামস্থ বিশ্ব কলোনির টাংকির পাহাড়ে ৩১টি পরিবার, টাংকি পাহাড় সংলগ্ন শান্তি নগর পাহাড়ে ৫৫টি পরিবার, উত্তর পাহাড়তলী ১৫০ দাগের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, নাছিয়া ঘোনা এলাকায় ১২টি পরিবার, চিড়িয়াখানার পিছনের পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, আকবরশাহ বেলতলী পাহাড়ে ৮৯টি পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশন পাহাড়ে ৪৬টি পরিবার, পলিটেকনিক্যাল কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩টি পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ২৯টি পরিবার, জালালাবাদ সংলগ্ন পাহাড়ে ৫টি পরিবার, নাগিন পাহাড়ে ২৫টি পরিবার, পূর্ব নাছিরাবাদের পাহাড়ে ১২টি পরিবারসহ রেলওয়ে, সড়ক যোগাযোগ বিভাগ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়ে ১৬২ পরিবার, ব্যক্তি মালিকানাধীন একে খান অ্যান্ড কোম্পানি পাহাড়ে ২৬ পরিবার, হারুন খান এর পাহাড়ে ৩৩ পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩ পরিবার, ভিপি সম্পত্তি লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ১১ পরিবার, এম আর সিদ্দিকীর পাহাড়ে ৮ পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৩২ পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১ পরিবার ও আমিন কলোনি সংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়ে ১৬ পরিবার।