বাঁশখালী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র :পুলিশ-শ্রমিক ব্যাপক সংঘর্ষ
ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি
নিজস্ব প্রতিনিধি, বাঁশখালী <<<
বাঁশখালীর গন্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ৫ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এতে পুলিশসহ ৩২ জন আহত হন। গতকাল সকাল আটটায় শুরু হওয়া এ সংঘর্ষ বেলা ১২টা পর্যন্ত চলে। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। নিহতরা হচ্ছেন মাহমুদ হাসান রাহাত (২২), রনি হোসেন (২৩), রায়হান (১৯), শুভ (২২) ও মাহমুদ রেজা (১৯)। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহতসহ ১৩ জন চিকিৎসাধীন আছেন।
নিহতের প্রত্যেক পরিবারকে ৩ লাখ টাকা, আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ১০ হাজার শ্রমিক ১৫ জন ব্যক্তির অধীনে কাজ করেন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। শ্রমিকদের বেতন ঘণ্টাপ্রতি ৫০ থেকে ৮০ টাকা। এ ভিত্তিতে শ্রমিকরা যত ঘণ্টা পরিশ্রম করবে তত ঘণ্টার বেতন পান। গত ৫ দিন ধরে শ্রমিকদের দাবি রমজান মাসে ৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করলে ১০ ঘণ্টার বেতন দিতে হবে। এভাবে ১১ দফা দাবিতে তারা আন্দোলন করে আসছিল। গত শুক্রবার রাতেও ওই আন্দোলন হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল শনিবার শ্রমিকরা কেউ কাজে যায়নি। এ ঘটনায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়োজিত পুলিশ ১৫ জন শ্রমিককে ধরে পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে আসে। আবার পুলিশ গিয়ে আরও কয়েকজনকে নিয়ে আসার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। এ সময় পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। পরিস্থিতি বেগতিক হলে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়া হয়। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে পুলিশ গুলি ছুঁড়লে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
বিকালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, ১০ হাজার শ্রমিকের একজনও সেখানে নেই। শ্রমিকরা আতঙ্কে পালিয়ে গেছে।
পরে স্থানীয় কিছু সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মালামাল লুট করে, বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে প্রতিটি দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৭টি মিক্সার গাড়ি, এসি মেশিন, বিভিন্ন স্থাপনা পুড়ে যায়। এতে আনুমানিক ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৬৩০ জন চায়না কর্মকর্তা ও শ্রমিক এবং ১৫ জন ব্যক্তির অধীনে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ৮ থেকে ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। শ্রমিকদের বেতন ভাতা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ নিয়মিত পরিশোধ করলেও নিয়োজিত ঠিকাদার ১৫ কর্মকর্তারা তাদের বেতন-ভাতা দিতে গড়িমসি করে এবং শ্রমিকদের বেতনের বৃহৎ অংশ কমিশনভিত্তিক কেটে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছিল।
পুলিশ দাবি, তাদের ৫ সহকর্মী শ্রমিকদের হামলায় আহত হয়েছেন। বাঁশখালীর সরকারি-বেসরকারি ৫টি হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ শ্রমিকরা চিকিৎসা নিয়েছে।
এদিকে, শ্রমিকদের ছুটাছুটির অবস্থা দেখে উপজেলা সদরে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। নিহতদের বন্ধু ও স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
বাঁশখালী হাসপাতালে নিয়ে আসার পর রক্তক্ষরণে মারা যায় ৪ জন, ওখান থেকে গুরুতর আহত ১৪ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর একজনের মৃত্যু হয়। আহতদের অনেকেই পুলিশের গ্রেফতারের ভয়ে বিভিন্ন স্থানে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে পালিয়ে গেছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন, জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ‘ঘটনা তদন্তে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে ৩ সদস্যের কমিটি ঘটনা করা হয়েছে। ওই কমিটি ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।’
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক বলেন, ‘চীনা কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের বাঁচাতে স্থানীয় উশৃঙ্খল শ্রমিকদের দমনে পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তির ইন্ধনে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়েছিল। শ্রমিকদের দাবি শুক্রবার রাতেই সমাধান করা হয়েছিল। আমাদের কাছে ভিডিও ফুটেজ আছে, তা দেখে প্রকৃত দোষী খুঁজে বের করা হবে।’