মোহীত উল আলম »
আমি পেশাগতভাবে একজন শিক্ষক। আমি চাই আমার ক্লাস সবসময় শিক্ষার্থীতে ভরা থাকুক। শিক্ষার্থীরা যাতে আকর্ষিত থাকে সে জন্য আমাকে প্রচুর পরিশ্রম করে ক্লাসের পড়া তেরি করতে হয়। শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর দিতে পারার মতো তৈরি থাকতে হয়। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষক হিসেবে আমার ওপর আস্থা রাখে সেজন্য আমাকে দিনরাত শিক্ষাপ্রদানের জন্য জ্ঞান আহরণ এবং সে জ্ঞান সুপেয়ভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবেশ করানোর জন্য আমাকে নানান কৌশল আয়ত্ত করতে হয়।
ঠিক সেরকম নির্বাচন কমিশনও চায় যে ভোটের সময় ভোটকেন্দ্র ভোটারে গিজগিজ করুক। যেমন রাজনৈতিক নেতা জনসভার ভাষণের সময় আশা করেন যে তাঁর বক্তৃতার সময় যেন মাঠে তিল ধারণের জায়গা না থাকে। অর্থাৎ, একজন শিক্ষকের শ্রেণিভর্তি শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আশা করা, একজন রাজনৈতিক নেতার মাঠভর্তি জনসমাগম আশা করা আর নির্বাচন কমিশনের ভোটকেন্দ্র ভর্তি আশা করার মধ্যে আলাদা আলাদা মাধ্যম বলে প্রকাশ আলাদা হতে পারে কিন্তু ভিতরের জিগিরটা একই। শিক্ষার্থীর সমর্থন, জনগণের সমর্থন, এবং ভোটারের সমর্থন বা আস্থা।
আজ বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর (নগর নয়) গাজীপুরের মেয়র নির্বাচন। সে সূত্রে ওপরের তুলনামূলক আলোচনাটা করলাম। সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমতউল্লাহ। আর যেহেতু বিএনপি এই সরকারের আমলে কোন ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলেছে, সে অর্থে আজমতউল্লাহ্ র প্রতিপক্ষ হিসেবে বলতে হবে জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুনকে। জাহাঙ্গীর ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন মেয়র হিসাবে। এবার তিনি প্রার্থী হতে চাইলেও দল থেকে প্রার্থী হিসেবে বাছাইকৃত হন আজমতউল্লাহ্। অন্যদিকে ঋণ খেলাপি হিসেবে নির্বাচন কমিশন জাঙ্গীরের প্রার্থিতাপদ অবৈধ ঘোষণা করে, আর নিজ দল থেকেও দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য তিনি স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত হোন। অন্যদিকে তাঁর মা জায়েদা খাতুনের প্রার্থিতা পদ টিকে যায়। এবং জাহাঙ্গীর মায়ের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে কাজ করছেন।
নির্বাচনের ফলাফল কি হবে সেটা জানতে আমাদের পরবর্তী সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যেটি আমার আলোচ্য বিষয় সেটি হলো ভোটারের স্বত:স্ফূর্ত সমর্থন, অর্থাৎ ভোটকেন্দ্রে বৈধ ভোটারের ভিড়।
একটি ঘটনা বলি, একটি নয় দুটি ঘটনা বলি, ভোটার সমাগমের ব্যাপারটা নিয়ে। ১৯৯১ সালের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের প্রথম জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে আমাকে দাপ্তরিক কাজে সিলেট যেতে হয়। সিলেট থেকে আসার পথে শ্রীমঙ্গল চায়ের বাগানে ফয়জুল মতিন নামক আমার এক বন্ধু ও আত্মীয়, যিনি সেখানকার একটি চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছিলেন,তাঁর বাংলোয় উঠি দুটো দিন বেড়াব বলে। মতিন আমাকে তাঁর জিপে করে বাগানে ঘোরাচ্ছিলেন, এবং এক পর্যায়ে শ্রীমঙ্গল শহরের বাজারে ঢুকলে দেখলাম সমস্ত এলাকা জুড়ে রাস্তার এপার-ওপার টানা পোস্টারে পোস্টারে শহরটা ছেয়ে গেছে। প্রচুর খন্ড খন্ড মিছিলও দেখতে পেলাম। এ সময় হঠাৎ মতিনের শিশু-বয়ষ্ক মেয়েটি পেছনের সিট থেকে জিজ্ঞেস করল, আব্বা, নির্বাচন মানে কী? মতিন চটজলদি জবাব দিলেন, মা, নির্বাচন মানে পছন্দ।
‘নির্বাচন মানে পছন্দ’ মেয়েকে দেয়া মতিনের এই জবাবটি আমার এত পছন্দ হলো যে এর আগেও নির্বাচন বিষয়ক যে কোন লেখায় আমি হয়ত এই ঘটনাটির উল্লেখ নিশ্চয় করেছি। এটাইতো নির্বাচন। যে বৈধ ভোটার তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে, নি:সংকোচে এবং নির্ভয়ে। তার ওপর কোন চাপ থাকবে না। কিন্তু সহজ কাজটিই যে কত কঠিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ”স্ত্রীর পত্র”-এর মৃণালের মতো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে হয় যে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজটি কেন পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজে পরিণত হয়। মৃণাল এ কথাটি বলছিলেন সংসারে স্ত্রীলোকের স্বাধীনতার ব্যাপারে, আর আমরা বলছি, ভোটের সময় ভোটকেন্দ্রে ভোটারের স্বাধীনতার ব্যাপারে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি বলি। ১৯৬৫ সালে আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ভারত-পাকিস্তানের সতের দিনের যুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। তখন দেশ জুড়ে সামরিক রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের অদ্ভুত আবিস্কার মৌলিক গণতন্ত্রের জজবা চলছে। এর মধ্যেই ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন এগিয়ে এলো। আমাদের কাজীর দেউড়ির ২ নম্বর গলির বাগমনিরাম ইউনিয়নের অধীনে কাউন্সিল মেম্বার নির্বাচন করছিলেন পাড়ার মুরব্বী পেয়ার মোহাম্মদ সওদাগরের জ্যেষ্ঠ ছেলে আব্দুল লতিফ, গোলাপ ফুল মার্কা নিয়ে। স্মৃতিতে এখনও ভাসছে পাড়ার লোকজনের মধ্যে কী প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা, যেন জীবন-মরণ সমস্যা। লতিফকে জিততেই হবে। (আমার ভাষাটি লক্ষ করুন: ‘জিততেই হবে’, ‘জেতাতেই হবে’ নয়। অর্থাৎ লতিফ সাহেব তাঁর জনপ্রিয়তার কারণেই জিতবেন, তাঁকে জনতার ভোট ছাড়া আর কোনভাবে জেতানো যাবে না।)র ক্রিস্টি নামক আমাদের একজন বন্ধু ছিল। তারা বাঙালি ক্রিশ্চান ছিল। সাধারণ মানের পরিবার। কিন্তু ভোটের তিনদিন আগে থেকে ক্রিস্টির মায়ের ছোট্ট বাসাটি পরিণত হলো লতিফ সাহেবের মূল প্রচারকেন্দ্রে। শত শত চায়ের কাপের উঠনামা আর বড় ডেকচিতে পানি গরম হচ্ছে, আর চা বানানো চলছে। সাথে মুড়ি কলা ডিম ভাজা। রীতিমতো উৎসব।
এই উৎসবটাতেই ঢিল পড়েছে বর্তমান নির্বাচনগুলোতে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে মোহরার উপ-নির্বাচনে শতকরা ১৫ জনেরও কম ভোট পড়েছিল। আর কারো খারাপ লাগুক না লাগুক, নির্বাচন কমিশনের নিশ্চয় খারাপ লাগার কথা। আমার ক্লাসে শিক্ষার্থী না এলে যেমন আমার খারাপ লাগে। পত্রপত্রিকা ঘেঁটে, এবং টিভির খবরাখবর দেখে বুঝতে পারলাম, গাজীপুরের ভোটারদের মধ্যে জমজমাট কোন উৎসাহ নেই। কেবলমাত্র নিয়ম রক্ষার্থে ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
কর্তৃপক্ষীয় সংস্থাগুলোর পক্ষে নিয়ম রক্ষার্থে কাজীর গরু কাগজে থাকলেই হলো, গোয়ালে না থাকলেও চলবে। সে জন্য তারা নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পেরেছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকার কথা বলবে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা জানে যে ফাঁকটা কোথায়, কিংবা ভোটার না আসলে কোথায় তাদের কামড়ায়। ব্যক্তির যেমন বিবেক থাকে, যেটা কামড়ায়, সেরকম সংস্থারও বিবেক থাকে যেটি কামড়ায়।
কর্তৃপক্ষীয় ‘কাজীর গরু’ খাতায় থাকলেই হলো এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে কোন সমাধানে আসা যায়। কিন্তু এটি কখনও বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটায় না। বাস্তবতার দিকে চোখ বন্ধ রেখে প্রলয় ঠেকানো যাবে মনে করার মধ্যে বেশ খানিকটা অবিমৃশ্য চিন্তা আছে। গাজীপুরের নির্বাচন সফল হোক এবং সকল দিক থেকে সত্যিকারের গণতন্ত্রের যুগ শুরু হোক।
প্রফেসর ড. মোহীত উল আলম : শিক্ষাবিদ ও লেখক