নিলা চাকমা »
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ (২০২২সালের ডিসেম্বর) মূল্যায়ন সূচকে দেশের ১৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অর্জন করেছে চমেক হাসপাতাল। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢামেক হাসপাতাল। তবে শ্রেষ্ঠ স্থান অর্জন করলেও চমেক হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে এমআরআই, ক্যাথল্যাব, ব্র্যাকি থেরাপি, ম্যামোগ্রাফি, এনজিওগ্রামসহ ডজন খানেক মেশিন অচল। এতে বাড়তি টাকায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পকেট কাটা যাচ্ছে রোগীদের। অনেক রোগী টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে পারছে না।
যেসব মেশিন অচল
এমআরআই : হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগে দুটি এমআরআই মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে একটি ২০১৪ সাল থেকে অকেজো। পরে ২০১৭ সালের আগস্টে আরেকটি এমআরআই মেশিন স্থাপন হয় এ বিভাগে। যার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এটির মেয়াদ ছিল তিন বছর। যা ২০২০ সালে অক্টোবরে অচল হয়ে যায়। পরে ২০২১ সালের মে মাসে আবার সার্ভিসিংয়ের মাধ্যমে মেশিনটি সচল করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেড। ওই সময় মেশিনটি সার্ভিসিং বাবদ সাড়ে ৯ লাখ টাকা বিল করে প্রতিষ্ঠান। তবে মাস না যেতেই ফের অকেজো হয়ে পড়ে মেশিনটি। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১০ মে থেকে একেবারে অচল হয়ে আছে মেশিনটি। এটি ঠিক করতে বর্তমানে ৯৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্ত চুক্তি অনুযায়ী ৬৩ লাখে ঠিক করার কথা। বাড়তি ২৯ লাখ টাকা দাবি করায় অচল রয়েছে মেশিনটি। হাসপাতালে ৪ হাজার টাকা দিয়ে এমআরআই করা যেত। এখন বেসরকারিতে রোগীদের সর্বনি¤œ ৯ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
ম্যামোগ্রাফি: নারীদের স্তন টিউমার-ক্যান্সার রোগ পরীক্ষা হয় ম্যামোগ্রাফি দিয়ে। চমেক হাসপাতালে একটি স্তন ৪০০-দুটো ৮০০ টাকা দিয়ে পরীক্ষা করা যেতো। কিন্ত হাসপাতালে এক বছরের মতো মেশিনটি অচল থাকায় বেসরকারি হাসপাতালে ১৫০০-৩০০০ টাকা দিয়ে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। এ মেশিন দিয়ে ২০১৮ সালে ৬ আগস্ট থেকে হাসপাতালে সেবা দেওয়া শুরু হয়। ২০২০ সালে আট মাস সেবা বন্ধ থাকে। ২০২১ সালে জুনে আবার সচল করা হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালের মে থেকে মেশিনটির সেবা বন্ধ।
ক্যাথল্যাব : ক্যাথল্যাব দিয়ে এনজিওগ্রাম, রিং পরানো, পেসমেকার স্থাপনসহ নানা কাজ করা হয়। চমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের ক্যাথল্যাব মেশিন রয়েছে দুটি। তার মধ্যে একটি সচল রয়েছে। আরেকটি ক্যাথল্যাব ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে অচল। এটি মেরামত করতে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা দরকার। সচল মেশিন দিয়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জনের এনজিওগ্রাম, রিং পরানো হয় ৩-৫ জন। অনেকে সিরিয়াল না পাওয়ায় বেসরকারি হাসপাতালে করতে হচ্ছে। চমেক হাসপাতালে ২ থেকে ৫ হাজার টাকার টাকা দিয়ে সেবা নেওয়া যায়। বেসরকারিতে তা ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা গুনতে হয়।
ব্র্যাকি থেরাপি : ২০১৯ সালের মে মাসে রেডিওথেরাপি বিভাগের ব্র্যাকি থেরাপি মেশিন স্থাপন করা হয়। নারীদের জরায়ুর ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ৬ জুন থেকে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে মেশিনটি। চমেক হাসপাতাল ছাড়া এ মেশিন চট্টগ্রামে কোনো হাসপাতালে নেই। যার কারণে বাড়তি টাকা খরচসহ নানা ভোগান্তি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে ব্র্যাকি থেরাপি করতে হচ্ছে নারীদের। অথচ চমেক হাসপাতালে এ মেশিন সচল থাকাবস্থায় মাত্র দেড় হাজার টাকা দিয়ে সেবা নিতে পারতেন রোগীরা।
সিটিস্ক্যান : রেডিওলোজি বিভাগে সিটিস্ক্যান দুটি। তার মধ্যে মাত্র একটি সচল রয়েছে। যেটি দিয়ে প্রতিদিন মাত্র ৪০-৫০ জনের সিটিস্ক্যান করানো যায়। এতে অনেক রোগীকে সিরিয়াল না পেয়ে বাইরে বাড়তি টাকা দিয়ে সিটিস্ক্যান করতে হচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে অচল পড়ে রয়েছে আরেকটি।
এছাড়া পায়ুপথ, রেকটাম ও কোলন বা বৃহদন্ত্রের একটি পরীক্ষা করার মেশিন কোলনস্কপি ২টি, পরিপাকতন্ত্রের রোগ নির্ণয়ের এন্ডোসকপি ১টি, ফুসফুস ও বায়ুপথ পরীক্ষার ব্রঙ্কোস্কোপি ২টি, পেটে পাথর জন্মালে বের করার এক্সট্রাকরপোরিয়াল শক ওয়েভ লিথোট্রিপসি (ইএসডব্লিউএল) মেশিন ১টি অচল রয়েছে।
হাসপাতালের ডজন খানেক মেশিন নষ্ট থাকার কারণে বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। তবে এসব সচল করতে কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালিয়ে গেলেও কবে নাগাদ ঠিক হবে সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
দীর্ঘদিন হাড়ক্ষয় রোগে ভুগছেন নোয়াখালীর বাসিন্দা মো. রাসেল উদ্দিন। এ সমস্যা নিয়ে এক চিকিৎসককে দেখানোর পর তাকে এমআরআই পরীক্ষা দেওয়া হয়। সুলভমূল্যে এই পরীক্ষা করানোর জন্য তিনি চমেক হাসপাতালে খবর নেন। কিন্ত হাসপাতালে গিয়ে শুনেন মেশিন অচল। বাধ্য হয়েই বেসরকারি হাসপাতালে তিনি এমআরআই পরীক্ষা করান। এতে তাকে গুনতে হয় ১২ হাজার টাকা। ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি নি¤œবিত্ত মানুষ। চমেক হাসপাতালে কম টাকায় এমআরআই পরীক্ষা শুনে এসেছিলাম। গিয়ে দেখি মেশিন নষ্ট। এত রোগীকে বাইরে থেকেই পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। অনেকে তো পরীক্ষাও করাতে পারেন না। গরিব রোগীদের সেবা নিশ্চিতে মেশিনগুলো দ্রুত সচলের উদ্যোগ নিলে ভালো হয়।
অচল মেশিনগুলো কবে নাগাদ সচল হবে এ প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকে। অধিকাংশই নি¤œবিত্ত রোগী। এসব রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে আমরা প্রস্তুত। কিন্ত অচল কিংবা সচল মেশিন ঠিক করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। এটা মন্ত্রণালয়ের দেখভাল করার বিষয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমআরআই, ক্যাথল্যাব, ব্র্যাকি থেরাপি, ম্যামোগ্রাফি মেশিন ঠিক করার জন্য আমরা বারবার চিঠি দিচ্ছি। কিন্ত কোনো সদুত্তর পাচ্ছি না। হাসপাতালে তো বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নেই যে, মেশিন অচল হওয়া মাত্রই সচল করা যাবে। তাছাড়া বেশির ভাগ মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ঠিক করে দেন। এটাতে মেরামত ফি বাবদ বড় অংকের টাকা দিতে হয়। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল অনুবিভাগ) নাজমুল হক খান বলেন, ‘মেশিন তো নষ্ট হতেই পারে। তা ঠিক করতে হবে। তার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো, আজিজুর রহমানের সাথে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সারতে হবে। যেহেতু সরকারি কাজ ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়। আশা করি চমেক হাসপাতালের সমস্যাও সমাধান হবে। আমি এই দায়িত্বে নেই, সবকিছু সচিবের কাছে। তিনিই সদুত্তর দিতে পারবেন।
তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আজিজুর রহমান বিদেশে অবস্থান করায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।