রাজাপাকসে পরিবারে বন্দি অর্থনীতি ও রাজনীতি
ডেস্ক রিপোর্ট »
বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দিনের প্রায় ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন, পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ ও জ্বালানির তীব্র সংকটে জনরোষ চরমে।
টানা ছ’মাস ধারাবাহিক ভাবে মূল্যবৃদ্ধির পারদ চড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে। মার্চ মাসে সে দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১৮.৭ শতাংশ। খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধি ৩০ শতাংশের বেশি।
গত এক সপ্তাহ ধরে ভয়ানক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে শ্রীলঙ্কা। দেশে জ্বালানির হাহাকার। প্রায় বন্ধ পরিবহণ। খরচ বাঁচাতে ১০-১৩ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে দেশ জুড়ে। এরই প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সন্ধেয় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন কলম্বোর মানুষ।
এই পরিস্থিতিতে ক্রমশ দানা বাঁধছে জনবিক্ষোভ। পরিস্থিতি সামলাতে শুক্রবার দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে।
ডিজেলের অভাবে গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে শ্রীলঙ্কায়। পাশাপাশি পণ্য পরিবহণে প্রভাব পড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গিয়েছে। জানুয়ারির গোড়ায় শ্রীলঙ্কায় ২৫ শতাংশ ছুঁয়ে রেকর্ড গড়েছিল মূল্যবৃদ্ধি। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ পর্বে তলানিতে ঠেকেছিল বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার।
সে সময়ই অর্থনীতিবিদের একাংশ শ্রীলঙ্কায় আর্থিক বিপর্যয়ের ভবিষ্যবাণী করেছিলেন। মাস ঘোরার আগেই সেই পূর্বাভাস মিলে গিয়েছে। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রের এই অর্থনীতি কখনও এমন খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যায়নি।
নিজেকে উন্নত দেশের সারিতে নিতে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণের দিকে হাত বাড়ায়। নতুন বন্দর, হোটেল ও অবকাঠামো তৈরি করা হয় ঋণের অর্থে। কিন্তু দিনশেষে যে জনকল্যাণে কোনো কাজে আসেনি, তা অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে।
শিক্ষা-দীক্ষায় দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশটির ‘ঋণ করে ঘি খাওয়া’র প্রবণতা দীর্ঘদিনের উল্লেখ করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাট’র গত ৯ ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৪ দশক ধরে শ্রীলঙ্কা বিদেশি ঋণের ওপর চরমভাবে নির্ভর করে আসছে। যেমন, ১৯৮৯ সালে দেশটির সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ ছিল মোট জিডিপির ৬২ শতাংশ।
সংকটের মূলে আছে— বাণিজ্য সংকোচন, করদাতার সংখ্যা কম ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের স্বল্পতা।
এসব সমস্যার সমাধান না হওয়ায় প্রতি বছর ঋণের বোঝা একটু একটু করে বেড়ে এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা যেন পুরো দেশটিকে ডুবিয়ে দিচ্ছে ঋণের মহাসাগরে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে তা এখন যেন আকাশ ছুঁয়েছে।
গত বছরের শেষের দিকে বিশেষজ্ঞরা সংকটের সম্ভাব্য তীব্রতা নিয়ে সতর্ক করলেও তা নিরসনে গুরুত্ব দেয়নি সরকার। বহু বছরের বিদেশি ঋণ ও তারল্য সংকটের মূল্য দিতে হচ্ছে।
দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধসে পড়ায় ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানি ফুরিয়ে যেতে থাকে। মুদ্রার দাম পড়ে যাওয়ায় তৈরি পোশাক ও চা রপ্তানিতে লাভবান হতে থাকেন রপ্তানিকারকরা।
কিন্তু যেসব ঋণ বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে হচ্ছে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যায়। ২০২১ সালে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ১২ শতাংশ হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, তা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে।
‘শক্তিশালী’ শ্রীলঙ্কার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গোতাবায়া রাজাপাকসে ভোটের বাক্সে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তা এখন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। দেশটি এখন আকণ্ঠ নয়, আপাদমস্তক ঋণের সাগরে নিমজ্জিত।
গত ১৮ মার্চ সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ ‘হাও ফোর পাওয়ারফুল ব্রাদারস ব্রোক অ্যান আইল্যান্ড নেশন’ শিরোনামের প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে কীভাবে প্রভাবশালী রাজাপাকসে পরিবারকে শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ তামিলদের বিদ্রোহ দমনে রাজাপাকসে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তারা গত ২ বছরে দেশটির অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিরসনে ব্যর্থ হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, এই পরিবারের বড় ভাই চমল রাজাপাকসে একজন মন্ত্রী। তার ছেলে মন্ত্রী না হয়েও বেশ প্রভাবশালী। অপর ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তাদের ভাগনে একজন সংসদ সদস্য।
ব্লুমবার্গ আরও জানায়, শ্রীলঙ্কার মোট বাজেটের ৭৫ শতাংশ রাজাপাকসের সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। সত্যি বলতে, একটি পরিবারের হাতে বন্দি শ্রীলঙ্কার রাজনীতি। তবে দেশটির সংকট নিরসনে যা করা প্রয়োজন তা তারা করতে পারেননি। উল্টো অনেক সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে গোতাবায়া রাজাপাকসে তার ভাই মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। মাহিন্দা প্রথম ক্ষমতায় আসেন ২০০৪ সালে। সেসময় গোতাবায়া ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ২০০৯ সালে তিনি তামিলদের ‘নির্বিচারে হত্যা’ করে বিদ্রোহ দমন করেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কায় সার নিষিদ্ধ করায় ধান ও চায়ের উৎপাদন কমে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটও সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যায়নি।
ঋণ থেকে উদ্ধার পেতে যদি আরও ঋণের দিকে যায় তাহলে হয়তো ‘দেউলিয়া’ হয়ে যেতে পারে দেশটি।
সূত্র : এএফপি ও ব্লুমবার্গ