তীর থেকে দূরে একটি সামান্য তামাশাগাছ

মো. আরিফুল হাসান :

একটি ছইওয়ালা নৌকা বাঁধা নদীটির পাড়ে। পাড় বলতে এটি কোনো ঘাট নয়। মাঠের মাঝখানে একটা মাঝারি মতো হিজলগাছ চকচকে সবুজপাতা মেলে আছে জলে-ডাঙায়। এর শেকড় জলের ঢেউ লেগে লেগে শাদা হয়ে আছে। মাঝিরা কেউ কেউ এখানে বসে বিশ্রাম করে। যাত্রী না থাকলে হিজলের ছায়ায় রৌদ্রক্লান্ত দেহটাকে জুড়িয়ে নেয়। নৌকার গলুইয়ে বসে কেউ কেউ তামাক সাজায়।

একজন বয়োবৃদ্ধ মাঝি এই দুপুরের রোদে তার হুঁকোতে আগুন দিচ্ছে। বেনা থেকে ফুঁ দিয়ে দিয়ে টিক্কায় আগুন ধরানোর সময় ফুয়ের দমকে ছাই ও ধোঁয়া মিলে তার চোখের সামনে একটা মরিচীকা নাচছে। বৃদ্ধ মাঝি একমনে ফুঁ দিয়ে চলছে বেনার আগুনে। টিক্কাটা লাল হয়ে আসলে কলকেতে রাবমাখা তামাকের ওপর রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে সামান্য চাপ দেয়। তারপর নারকেলের মালার ফুটোতে মুখ রেখে গুড়গুড় করে টান মারে মাঝি। দুপুরের রোদের ঝলক মুহূর্তেই তার ভেতরে গিয়ে সবকিছু পুড়িয়ে একদম শীতল করে দেয় তাকে। সে স্থির চোখে জলের দিকে তাকায়।

মাঝির বয়েস ছাপ্পান্ন কি সাতান্ন; তার বেশি হবে না। অথচ তাকে দেখলে যে কারোরই বয়োবৃদ্ধ মনে হবে। রোগে-শোকে-অভাবে, এভাবে এদেশের অন্ত্যজমানুষেরা খুব তাড়াতাড়িই মৃত্যুসীমানায় পৌঁছে যায়। বৃদ্ধও ধুঁকছে। তাকে দেখে বোঝা যায় জীবনের তেল তার প্রদীপ আলোক আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না। মাঝি স্থিরদৃষ্টিতে জলের দিকে চেয়ে আছে।

তার মেয়ের নাম কুলসুম। বিয়ে দিয়েছিল তিন ক্রোশ দূরে কৈলাসপুর। আজ অপবাদ উঠেছে তার মেয়ের নাকি চরিত্র ভালো না। ভাসুর না কার সাথে যেনো ধরা খেয়েছে। মাঝি যাচ্ছে তার মেয়েকে নিয়ে আসতে। এই তিন ক্রোশ পথ এখন মাঝির কাছে মনে হচ্ছে তিনভুবনের পথ। তার দক্ষ হাতের বৈঠা উজানের জল ঠেলে যেন ওপরে উঠতে চায় না। সারাক্ষণ ভাটার টানে যেন ডুবতে চায় তার নাও। মাঝি বুঝতে পারে না, যেই এক ঘন্টার পথ তার পাড়ি দেবার, সে পথ আজ তিন ঘণ্টায় সামান্য অর্ধেকও আসতে পারেনি কেন সে।

মাঝি তামাকের সাথে বিষ মিশিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু বিষ কেনাটাও যখন কখনো-কখনো বিলাসিতা হয়ে পড়ে তখন আর মরার মতোও কোনো জো থাকে না। অগত্যা বেঁচে থাকতে হয়। ধুঁকে ধুঁকে, ধিকৃত হয়ে বেয়ে যেতে হয় ভাঙা তরী। বৃদ্ধ মাঝি একবার বিরাম দেয়, ভাবে। আবার ভাবে তার মেয়েকে কে দেখবে? সে বেঁচে থাকতে চায়, কিন্তু জীবন তাকে চায় না। সে মরতে চায়, কিন্তু জীবন তাকে নিষ্কৃতি দেয় না।

বৃদ্ধ মাঝি আবার তার তামাকে টান মারে। গুড়গুড়গুড় গুড়গুড়গুড় করে দুপুরের রোদে ধোঁয় বেরোয়। টানের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে টগবগে রোদ। কিন্তু তার দেহের ভেতর উত্তাপিত হয়ে ওঠে না। ভেতরটা কেমন মরে যেতে থাকে, টের পায় সে। কিন্তু এই হিজলের ছায়ায় তার দেহটায় যে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হচ্ছে না এটিও সে জোর দিয়ে বলতে পারে না। ধীরে ধীরে তার ভেতরে একটি প্রতিযুক্তি দাঁড়িয়ে যায়Ñ ‘মাইয়া যুদি কুলটা অয়, তারে আমি লইয়া আমু। আর যুদি হে এমুন না অয়, তারে আমি জামাইর বাড়িত খুন কইরা আমু।’ মাঝি বুঝতে পারে না তার ভেতরে এই দ্রোহটা কেনো জাগে? সে কি তবে জানে, তার মেয়েটা নির্দোষ?

কৈলাসপুর গ্রামের সব লোকজন ভেঙে পড়েছে কুলসুমের স্বামীর বাড়িতে। তিনমাস হয়নি বিয়ে হয়েছে। এখনি মেয়ের এমনতর সাহস! গ্রামের বৌÑঝিয়েরা বিশ্বাস করতে চায় না। তারা আঁচলে মুখ ঢেকে সন্দেহের চোখে সবকিছু অবলোকন করে। কেউ একজন বলে, মা না থাকলে এমুন অই অয়। বাপ হারে দিন নৌকাত থাকছে, মাইয়ার তো হারেদিন অই পুষমাস! তবুও কারও কারও বিশ্বাস হয় না কথাটা। নিরীহ হাড় ঝিরঝিরে মেয়েটার চরিত্র খারাপ, এই কথা কারো কারো যুক্তিতে মেলে না। ‘চরিত্র অওয়ার লাইগ্যাও তো একটা দেহ লাগে, নাকি?’ কোনে কোনো বৌ একে অপরকে প্রশ্ন করে।

ছনের ছোট্ট ঘরটাতে বেড়া ভেঙে লোকজন দাঁড়িয়েছে। মাঝখানে তিনটা জলচৌকিতে তিনজন গ্রামের হোমরা-চোমরা। একটা হাতাভাঙা ধার করা চেয়ারে গ্রামের মেম্বার বসা। মেম্বারের সামনে উবু হয়ে বসে আছে কুলসুম। সে প্রায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। মেম্বার উপস্থিত লোকজনদের উদ্দেশ্যে বলে, মাইয়ার বাপ আইয়ে নাই? এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কেউ গলা তুলে বলে, দেহি না দ। আইবো ক্যামনে, মাইয়া কি হেই মুখ রাখছে?

উপস্থিত লোকজনের মাঝে একটি গুঞ্জন ভেসে চলে। কুলসুমের স্বামী এক কোনায় দাঁড়িয়ে বলে, মাগিরে পুইড়া ফালাই। স্বামী পরিবারের এক দুজন সায় দেয়, হ হ। মেম্বার ধমক দিয়ে সবাইকে থামায়। মানুষ পুইড়া মারে ক্যামনে? আইচ্চা, আমি মাইয়াডার কথা হুইন্নালই। অই মাইয়া, তোমার কোনো কথা আছে?

কুলসুম আরও বেশি মাটির সাথে মিশে যেতে থাকে। মেম্বার পূনরায় গলা চড়ায়, কী মাইয়া, কথা কও না কেরে? কুলসুম মাটির ভিতর থেকে আস্তে করে জবাব দেয়, আমি এই কাম করি নাই। এ কথা কেউ না শুনলেও কুলসুমের স্বামীর কানে কথাটা পৌঁছে যায় এবং সে আতঙ্কিত হয়ে জ্ঞানশূন্যভাবে কুলসুমকে মারতে থাকে। মেম্বারসহ উপস্থিত লোকজনেরা তাকে থামায় এবং একপাশে নিয়ে ধরে রাখে। পরিস্থিতিতে কুলসুমের কথাটা কর্পূরের মতো ভেসে যায়।

দ্বিতীয়বার মার খেয়ে কুলসুম আরও বেশি মাটির সাথে মিশে যায়। তার আর এখন মনে পড়ে না গত রাতে সে কী দেখেছিল। মস্তিষ্কের ভেতর বৈঠার আঘাত শুনতে পায়, শুনতে পায় ছলাৎ ছলাৎ জলের ঢেউ ভাঙছে বৃদ্ধ পিতার জীর্ণ নৌকোটিতে। সেই দৃশ্যচিত্র নিংড়ে চোখের সামনে এক পর্দা কাঁপতে থাকে, সেখানে ছায়া ছায়া সে দেখতে পায় তার স্বামী বড় জা’র ঘর থেকে ফিরছে। তারপর আর সে কিছু মনে করতে পারে না। সে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে আসলে সিদ্ধান্ত হয় তার চুল কামিয়ে মাথায় ঘোল ঢেলে মুখে চুনকালি মেখে বাবার বাড়ির পথে খেদিয়ে দেয়া হবে। তখন বিকেল আসন্ন। লোকজন তামাসা দেখতে দেখতে কুলসুমের পেছনে পেছনে কিছুটা পথ আসে। কুলসুম চলতে পারে না। তার দেহ ভেঙে আসে। কিন্তু বসতে গেলেই ছেলে- ছোকরারা ঢিল মারে পেছন থেকে আর হৈ হৈ করে তাড়া দেয়। একসময় পেছনের লোকজন কমে আসে। এক সময় শেষ হয়। কুলসুম একা তাকে নিয়ে বয়ে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়। সে একটি জঙ্গলে গা-ঢাকা দেয়।

৩.

সন্ধ্যার পর কুলসুম তার বাবার বাড়ির পথ চিনতে চিনতে রওয়ানা দেয়। জঙ্গল থেকে নেমে ধানখেতের ভেতর দিয়ে সে হাঁটতে থাকে। সুতার মতো ভেজা পিছল আলপথ, তার কাপড় কর্দমাক্ত হয়। সে পা পিছলে পড়ে যায় কয়েকবার। ঝিনুকে শামুকে, কাকড়ার কঙ্কালে লেগে তার পা-কনুই রক্তাক্ত হয়। তবুও সে পথ চলে ধুঁকে ধুঁকে। আকাশে লালিমারেখা কেটে গেছে। একখ- চাঁদ উঠবে উঠবে করছে। সেই অস্পষ্ট আলোয় কুলসুম হাঁটতে হাঁটতে তার পথ সংক্ষিপ্ত করে ফেলে। মাঠের মাঝখান দিয়ে আসার ফলে সে শীঘ্রই নদীপাড় পৌঁছে যেতে পারে।

নদীর পাড় ধরে হাঁটতে এখন আর তার অসুবিধা হচ্ছে না। ঐ তো দূরে তার চিরপরিচিত হিজলগাছটি দেখা যাচ্ছে। বাবার সাথে কতবার সে এ গাছের ছায়ায় জিরিয়েছে! তার বাবার কথা মনে হয়। অভিমান হয় বাবার প্রতি। সে তাকে নিতে আসলো না কেন? কুলসুমের একবার মনে হয়, ফিরবে না সে বাবার ঘরে। তারপর আবার মনে হয়, বাবা ছাড়া তার আর আছে কে?

কুলসুম আরেকটু এগিয়ে থমকে দাঁড়ায়। তার বাবার ছইওয়ালা ডিঙিখানি হিজলছায়ায় আবছায়ার মতো দেখা যায়। কুলসুমের ইচ্ছে হয় বসে যায়, অভিমানে তার দেহ গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে নদীর পাড়ে মিশে যেতে থাকে। কুলসুমের ইচ্ছে হয়, ঝড়ের মতো সে তার বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুলসুম তীর ভেঙে উপচে পড়া ঢেউয়ের মতো ছুটতে থাকে। ঝাপসা অন্ধকারে সে শেষ শক্তি দিয়ে ডেকে উঠে, বাবা আ আ আ …