ভূঁইয়া নজরুল »
মানুষ ও পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক ডিডিটি (ডাইক্লোরো ডাফেনাইল ট্রাইক্লোরেথেন ) পাউডার মুক্ত হচ্ছে চট্টগ্রাম। ৩৮ বছর ধরে আগ্রাবাদ কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের গোডাউনে রক্ষিত ৫০০ মেট্রিকটন ডিডিটি ১৯৮৪ সালে পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে আনা হয়েছিল। মূলত: ম্যালেরিয়া মশা নিধনের জন্য আনা কীটনাশক সারাবিশ্বে নিষিদ্ধ করার পর থেকে তা গোডাউনে জমা রয়েছে। অবশেষে পরিবেশ রক্ষায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খরচে বিশেষ জাহাজে করে তা এপ্রিলের মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে যাওয়া হবে।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এসব ডিডিটি পাউডার সরিয়ে নিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় তিনি চট্টগ্রাম থেকে এসব ক্ষতিকর পণ্য কিভাবে সরিয়ে নেয়া যায় তা নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘এপ্রিলের মধ্যে চট্টগ্রাম ডিডিটি মুক্ত হবে। এই সময়ের মধ্যে ওষুধাগার থেকে ৫০০ মেট্রিকটন ডিডিটি বিশেষ ব্যবস্থায় প্যাকেজিং করে এবং বিশেষ জাহাজে করে ফ্রান্সে নিয়ে ধংস করা হবে। ইতিমধ্যে বিদেশের বিশেষজ্ঞ টিম গত সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।’
তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তত্ত্বাবধানে এই অপসারণ কাজটি করা হচ্ছে। আর জাতীয়ভাবে একটি প্রকল্পের অধীনে তা সমন্বয় করা হচ্ছে। সেই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন পরিচালক।
কিভাবে অপসারণ করা হবে?
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ৫০০ মেট্রিকটন ডিডিটি কিভাবে অপসারণ করা হবে জানতে চাইলে ডিডিটি মুক্তকরণ প্রকল্পের ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘ডিডিটিগুলো প্যাকেটিং করার জন্য কিছু যন্ত্রপাতি ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রবেশ করেছে এবং কিছু পণ্য বাকি রয়েছে। গ্রিসভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান ‘পলিয়েকো’ ডিডিটি অপসারণের কাজটি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে পেয়েছে। তাদের সাথে স্থানীয়ভাবে কাজ করছে এভারগ্রিন নামের একটি প্রতিষ্ঠান।’
তিনি আরো বলেন, ডিডিটিগুলো বিশেষভাবে প্যাকেজিং ও জাহাজীকরণ করার জন্য পলিয়েকো এখানকার কর্মীদের বিশেষ ট্রেনিং করাবেন। আগামী সপ্তাহ থেকে হয়তো তাদের ট্রেনিং কার্যক্রম শুরু হবে। আর তারপরই প্যাকেটিং শুরু হবে। বিশেষ কনটেইনার ও জাহাজে করে এগুলো ফ্রান্সে নিয়ে ধ্বংস করা হবে।’
ধ্বংস কার্যক্রমের খরচ কে বহন করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি প্রকল্পের আওতায় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এই অর্থায়ন করছে।
কিভাবে এলো এই ডিডিটি?
আগ্রাবাদ কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের সহকারী পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘১৯৮৪ সালে পাকিস্তান থেকে ৫০০ মেট্রিকটন ডিডিটি আমদানি করা হয়েছিল। সেই আমদানি পণ্য এই ওষুধাগারে রক্ষিত করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পর তা এখন পর্যন্ত রয়ে যায়।’
পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এখানকার ডিডিটি স্থানীয় এলাকার মাটি ও পানির সাথে মিশে গিয়েছিল। এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ওষুধাগারে কর্মরত কর্মীরা জানায়, ডিডিটিগুলো পানির সাথে মিশে দইয়ের মতো হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন এসে এখানকার গাছের ফল ও এই এলাকার পানি পান করতে নিষেধ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ঝুঁকির মধ্যে অফিস করে এখানকার কর্মীরা।
তবে গত বৃহস্পতিবার এই ওষুধাগারের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে জানিয়ে আগ্রাবাদ কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের সহকারী পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমরা পাশের একটি ভবনে অফিস স্থানান্তর করেছি। ডিডিটি স্থানান্তর হওয়ার পর যেদিন আমাদের আসতে বলবে সেদিন আমরা এই কার্যালয়ে আসবো। এখন থেকে অফিস ক্যাম্পাস পরিবেশের পরিচালকের অধীনে।’
এবিষয়ে কথা হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (আইটি) ফরিদ আহমেদের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো অফিস ক্যাম্পাস বুঝে নিয়েছি। বিদেশি বিশেষজ্ঞ টিম ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।’
কেন আনা হতো ডিডিটি?
ওষুধ গবেষণাগারের কর্মকর্তা, পরিবেশবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একসময় দেশে ম্যালেরিয়ার খুব প্রাদুর্ভাব ছিল। ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন পোকামাকড় থেকে বাঁচতে ডিডিটি ব্যবহার করা হতো। মূলত: দেশের তিন পার্বত্য জেলায় এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি ছিল। এজন্য ডিডিটিগুলো আমদানি করা হয়। এছাড়া চট্টগ্রামে একটি সরকারি কারখানা ও একটি বেসরকারি কারখানাও ছিল ডিডিটি প্রস্তুত করার জন্য। সেগুলোও পরবর্তীতে বন্ধ করা হয়।
পরিবেশের কি ক্ষতিসাধন করে ডিডিটি?
রসায়নবিদ প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘১৯৩৯ সালে ডিডিটি’র ব্যবহার আবিষ্কার করেছিলেন সুইস বিজ্ঞানী ড. পাউলি হারমার মুলার। পরবর্তীতে যুদ্ধক্ষেত্রে এবং সারা বিশ্বে পোকামাকড় দমনে এই ডিডিটি ব্যাপক ব্যবহার হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকরা ডিডিটি ব্যবহার করলে কোনো পোকামাকড় আসতো না। বিশ্বজুড়ে এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ১৯৪৮ সালে মুলার নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন। ’
তাহলে তা ক্ষতিকারক কিভাবে প্রমাণিত হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ষাটের দশকে বিজ্ঞানীরা দেখলেন ব্যাপকহারে ডিডিটি ব্যবহারের ফলে পরিবেশ থেকে পোকামাকড় ও বিভিন্ন প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে উন্নত দেশগুলো এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ৭০ এর দশকে। সবশেষে জাতিসংঘ স্টকহোম কনভেনশনের মাধ্যমে এর উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে।
পরিবেশবিদদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডিডিটি কখনো ধ্বংস হয় না। তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে শরীর থেকে মাটিতে মিশে। মাটি থেকে খাদ্য চেইনের মাধ্যমে আবারো শরীরে প্রবেশ করে। মানুষ ও পরিবেশের জন্য তা খুবই ক্ষতিকারক।
জানা গেছে, ২০০১ সালে স্টকহোম কনভেনশনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশক উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ বা সীমিতকরণ সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তিতে বিশ্বের ১৭১টি দেশ স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ ২০০১ সালের ২৩ মে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং ২০০৭ সালের ১২ মার্চ থেকে যা কার্যকর হয়।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরে এসব ডিডিটি অপসারণের জন্য কাজ চলছিল। যেহেতু এগুলো অপসারণ অনেক ব্যয়বহুল ও অনেক টেকনিক্যাল তাই জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয় সরকার। জাতিসংঘের মাধ্যমেই তা অপসারণ করা হচ্ছে।
ডিডিটি মুক্ত হচ্ছে চট্টগ্রাম
পরিবেশ সুরক্ষা অপসারণের জন্য গ্রিস থেকে বিশেষ উপকরণ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে, ৫০০ মেট্রিকটন ডিডিটি বিশেষ জাহাজে করে ফ্রান্সে নিয়ে ধ্বংস করা হবে