সুপ্রভাত ডেস্ক »
দেশে ডলারের সংকট চলছে প্রায় দুই বছর ধরে। বিদেশি এই মুদ্রাটির চাহিদা থাকায় সদ্য সমাপ্ত বছরে ধারবাহিকভাবে বেড়েছে দাম। বছরের শেষের দিকে সামান্য দর কমিয়েছে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। তবে সংস্থা দুটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অনেক বেশি দামে ডলার কেনা-বেচা করেছে অধিকাংশ ব্যাংক। দুবার শাস্তির মুখেও পড়তে হয়েছে কয়েকটি ব্যাংককে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, বর্তমানে আন্তব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা। ২০২৩ সালের জানুয়ারি ১ তারিখে প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছিলো ১০৭ টাকা দরে। অর্থাৎ গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মান কমেছে ৩ টাকা। খবর অর্থসূচক।
এদিকে ব্যাংকগুলোয় ডলারের দামের হিসাবে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে অনেক বেশি। কারণ অনেক ব্যাংক এবিবি ও বাফেদার নির্ধারিত দাম মানছে না। গত বছরের শেষের দিকে ১২৪ টাকা দিয়েও রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে কয়েকটি ব্যাংক। ডলারের এ দাম তখনকার খোলাবাজারের চেয়ে ৫ টাকা ও বাফেদার নির্ধারিত দরের চেয়ে প্রায় ১৪ টাকা বেশি ছিলো।
অপরদিকে খোলা বাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ ২০২৩ সালের শেষের দিকে খোলা বাজারে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে ডলার বিক্রি করা হয়। এ সময় প্রতি ডলারের দাম ঠেকেছিলো প্রায় ১৩০ টাকা। এর আগে সদ্য সমাপ্ত বছরের অক্টোবরের শুরুতে খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকায় ওঠে। এরপর দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে বিদেশি এই মুদ্রাটির দাম।
বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলার বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি শুরু থেকেই ভুল ছিলো। এর ফলে টাকার মূল্যমান নিয়ে বেশ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কার্ভ মার্কেটের সঙ্গে ইন্টারব্যাংক মার্কেটে ডলার-টাকার বিনিময় হারে বড় পার্থক্য বিরাজ করছে। অনেক আগেই ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিলো। এসব সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকিংয়ের বেশ কিছু সমস্যা।
অন্যদিকে ২০২২ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল ২১ দশমিক ২১ শতাংশ। ওই বছরের শুরুতে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। বছর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিলো ১০৪ টাকা। আলোচ্য সময়ে এ মুদ্রাটির দাম বেড়েছিলো ১৮ টাকা ২০ পয়সা।
এর আগে ২০২২ সালে ঘোষিত দরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনায় ৬টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরেও ১০টি ব্যাংক বেশি দামে ডলার ক্রয় করে। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর গত ২৭ সেপ্টেম্বর ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা জরিমানা করেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক।
অপরদিকে ডলার সংকটের প্রভাবে ধারবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ। সংকট সমাধানে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে আমদানি কিছুটা কমেছে, তবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে ব্যপকহারে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৪৩ কোটি ডলার। চলতি জানুয়ারি মাসের শুরুতে যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। আকুর পেমেন্ট ও ডলার বিক্রি অব্যাহত থাকায় এক সপ্তাহে রিজার্ভ কমেছে ১৫৬ কোটি ডলার।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন মজুমদার বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। কারণ আমাদের উৎপাদন বিদেশি কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল, যেগুলো বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। আরেকটি খারাপ দিক হলো মুদ্রা হিসেবে টাকা আস্থার সংকটে পড়েছে। অর্থপাচার রোধ করতে পারলে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আনার ব্যবস্থা করতে পারলে এই সংকট সমাধান করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
ডলার সংকটের চাপ সামলাতে আমদানি পণ্যের এলসিতে পণ্যভেদে ৭৫ শতাংশ থেকে শতভাগ মার্জিন আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রভাবে কমে গেছে আমদানির পরিমাণ। সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালের অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বর মাসে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৩৪ কোটি ডলার। অপরদিকে জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি বেড়েছে গত বছরের তুলনায় মাত্র ৩ শতাংশ।
এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত নভেম্বর মাসে নীতি সুদহার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো ধার করা টাকার সুদহার বেড়েছে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কিছু কারণে দেশে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি করা হচ্ছে বেশি। সমাপ্ত বছরজুড়ে প্রবাসী আয়ের পরিমাণও আশানুরূপ ছিলো না। ডলার আয়ের চেয়ে এখন খরচ বেশি হচ্ছে।
অনেক সময় দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাজারের সূচক দিয়ে বিচার করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের বিপরীতে টাকা মানে পতন চলছে। পুঁজিবাজারে এখনো চালু রয়েছে ফ্লোর প্রাইস। এসবের প্রভাবে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমছে। ২০২৩ সাল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের জন্য মোটেও ভালো ছিলো না। ব্যাপক হতাশার মধ্যে দিন কেটেছে বিনিয়োগকারীদের। বছরটি শুরু হয়েছিল যখন ‘ডিএসইএক্স’ ছিল ৬ হাজার ২২৯ পয়েন্ট। বছরের শেষ কার্যদিবস ২৮ ডিসেম্বর ‘ডিএসইএক্স’ দাঁড়ায় ৬ হাজার ২৪৬ পয়েন্ট।