শুভ্রজিৎ বড়ুয়া
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ঠান্ডার মাত্রা বাড়ছে। এতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ। অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হলেও অধিকাংশ সেবা নিচ্ছেন হাসপাতালের বর্হিবিভাগে। অন্যদিকে শীতের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। তাই বাড়তি সতর্কতা জরুরি বলে জানান স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সূত্রে জানা যায়, ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২২ সালে ভর্তি হয়েছিল ৪ হাজার ৬৫৩ জন। আর ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪০ জনে। এ বছরের প্রথম ১৫ দিনে ১২৫ জন ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়েছে।
চমেক হাসপাতালের ডেপুটি নার্সিং সুপারিনটেডেন্ট নুরুননাহার বেগম বলেন, ‘ঠান্ডাজনিত রোগের মধ্যে যারা হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া রোগ নিয়ে আসে তাদের বাড়তি নজরদারিতে রাখতে হয়। এ সময়টা সবার জন্যই খুব সেনসেটিভ। এরপরও আমরা নবজাতক ও বয়ষ্কদের সাবধানতা অবলম্বন করতে বলি।’
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ফজলে রাব্বি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগী ভর্তি আছে। কিন্তু ভর্তির চেয়ে বর্হিবিভাগে রোগীর সংখ্যা খুব বেশি। বর্হিবিভাগে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ রোগী সেবা নিয়ে থাকেন। এখন যারা সেবা নিচ্ছে তাদের তিন ভাগের দুই ভাগ হলো ঠান্ডাজনিত রোগী। এর অন্যতম কারণ হলো মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন। ধুলোবালি বা ধোঁয়াতে মাস্ক বা যে কোনো প্রতিরোধক ব্যবহার করছি না। ঠিকমতো ত্বকের যত্ন নিই না। আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনা হচ্ছে। এসবের কারণে অধিকাংশ রোগীদের বেলায় ন্যূনতম পাওয়ারের ওষুধ কাজ করছে না।’
চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি, মেডিসিন ও শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, কনকনে শীতেও রোগীদের বেডে ঠাঁই না হওয়ায় মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কেউ কেউ বারান্দায়ও শুয়ে আছেন। ঠান্ডাজনিত রোগের মধ্যে অতিরিক্ত কাশি, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, জ্বর, টনসিল, ডায়রিয়া ও ত্বকের নানা ধরনের রোগ নিয়ে অনেকে এসেছেন। এর মধ্যে শিশু ও বয়স্ক রোগীদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। দৃশ্যত রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে ভোগান্তিতে রয়েছেন শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির রোগীরা। বেডের তুলনায় রোগীর পরিমাণ বেশি হওয়ায় তাদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
চমেক হাসপাতালের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হওয়া শিশু রাইয়ানের মা বলেন, ‘নেবুলাইজ করার জন্য বসে আছি। রোগীও এখানে বেশি! নেবুলাইজ করার জন্য সিরিয়াল ধরে থাকতে হয়। আমার ছেলেটা ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। ওর কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। নেবুলাইজার দিলে একটু ভালো থাকে। কিছুক্ষণ পরে আবার কান্না শুরু করে।’
ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. রাজশ্রী চৌধুরী বলেন, ‘শীতে আমাদের ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। ড্রাইনেসের জন্য ভেসলিন বা অলিভ ওয়েল ব্যবহার করলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু অধিকাংশ রোগীদের ক্ষেত্রে তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকা বা ওভার ক্রাউডেড থাকার কারণে বিভিন্ন রকমের রোগ হয়। খুশকি কিংবা ফাঙ্গাল রোগগুলো সাধারণত বেশি হয়। এছাড়া বিশেষ করে ডায়বেটিক রোগীরা এলার্জিজনিত কারণে চুলকানির সমস্যা নিয়ে আসে। এসব রোগীদের চিকিৎসায় বড় সমস্যা হলো- তারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টি-ফাঙ্গাল ক্রিম লাগিয়ে নিজেরাই রোগ সারাবার চেষ্টা করে। পরে সমাধান না হলে চিকিৎসকের কাছে আসেন। তখন আমরা আর ওষুধ দিয়ে আশানুরূপ ফল পাই না। এছাড়া অনেকে দুই-তিনদিন ওষুধ খেয়ে তারপর ওষুধ বন্ধ করে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন করে স্ক্যাবিস রোগাক্রান্তের সংখ্যা বেশি পাচ্ছি। রোগটা মারাত্মক সংক্রামক। এ রোগ হলে আঙুলের ফাঁকে, বগলে, নাভিতে বা ভাঁজ পড়া ত্বকে ‘বিচি-পাঁচড়া’ ওঠে। মূলত সংক্রমক ভাইরাসটি ত্বকের নিচে ১৪ থেকে ২০ দিন সময় নিয়ে ডিম পাড়ে। এরপর রোগটা হয়। আমরা প্রতিদিন গড়ে ৮০ জন রোগী দেখলে এরমধ্যে ৩০-৪০টি স্ক্যাবিস রোগী পাচ্ছি। এটি না হওয়ার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নাই।’
চমেক হাসপাতালের শিশু রোগ ওয়ার্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. একেএম রেজাউল করিম বলেন, ‘ঠান্ডাজনিত রোগী স্বাভাবিকের তুলনায় এখনও বেশি আছে। তবে এখনও মাত্রা অতিক্রম করেনি। এ রোগগুলো মানুষ চাইলে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। ঠান্ডা, ধুলোবালি ও ধোঁয়াকে এড়িয়ে চলতে হবে। এরমধ্যে বেশি বয়ষ্ক ও শিশুদের বেলায় বিষয়টি ভিন্ন। তাদের অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এরমধ্যে নিউমনিয়া বা শ্বাসকষ্টটা খুব জটিল। আমরা হাসপাতালে কিংবা আমাদের আউটডোর চেম্বারে এখন শিশুদের ঠান্ডাজনিত সমস্যা বেশি দেখছি। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। আর তারা কেমন লাগছে, তা প্রকাশ করতে পারে না। এখনতো ঠান্ডা পড়ছে। হয়তো সপ্তাহ খানেক পরে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। তাই শিশুদের যে কোনো সমস্যা দেখলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কোনো বিকল্প নাই।’
এদিকে আরো ছয় থেকে সাতদিন ঠান্ডা থাকতে পারে বলে জানান আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা কিছুটা কম রয়েছে। তবে তাপমাত্রা যতটা কম, তার চেয়ে ঠান্ডার পরিমাণ অনেকটা বেশি। এটাকে শৈত্যপ্রবাহ বলা যাবে না। এরকম আবহাওয়া আরও ছয়-সাতদিন থাকতে পারে। এরপর তাপমাত্রা কিছুটা বাড়বে। তবে ঠান্ডা আরও বেশ কয়েক সপ্তাহ পড়তে পারে।’