কামরুল হাসান বাদল »
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে চট্টগ্রামবাসীকে আবার পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে। আবার সড়কে দাঁড়াতে হচ্ছে। পৌনে দু বছর আন্দোলন করে সিআরবি রক্ষা করার পৌনে দু বছর না পুরাতে সে সিআরবির আরেকটি অনন্য সুন্দর স্থানকে রক্ষার দাবিতে আন্দোলনে যেতে হচ্ছে। আরও দুঃখজনক হলো নগরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম যে প্রতিষ্ঠান এবং তার প্রধান সিআরবি রক্ষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন, সে প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের বিপক্ষেই আন্দোলন করতে হচ্ছে।
সিডিএ চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ করেছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৪ নভেম্বর ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন। মূল অংশের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ শেষ না হওয়ায় যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠা-নামার পথ) রয়েছে। এর মধ্যে টাইগারপাসে রয়েছে দুটি। একটি দিয়ে গাড়ি উঠবে এবং আরেকটি দিয়ে নামবে। গাড়ি ওঠার র্যাম্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী অংশ দিয়ে। আর এই র্যাম্প নির্মাণ করতে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হলেও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকা গাড়ি নামার র্যাম্পটির (আমবাগান সড়কমুখী) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। কাটার জন্য গাছ চিহ্নিত করে নাম্বার দেওয়ার পর এখন চট্টগ্রামবাসী আপত্তি জানাচ্ছে টাইগারপাস থেকে ঊর্ধ্বমুখী র্যাম্পের বিষয়ে।
চট্টগ্রাম নগর প্রাকৃতিকভাবেই অনন্য। নগরের মাঝখানে নদী, নগর ঘেঁষে সাগর, নগরজুড়ে ছোটবড় অসংখ্য পাহাড় আর তার গা ঘেঁষে সড়ক এমন নগর বিশ্বে আর নেই।
তেমন একটি সড়ক পলোগ্রাউন্ডের পাশ দিয়ে টাইগারপাস মোড়ে মিলিত হয়েছে। সড়কটি নগরবাসীর কাছে ‘ দোতলা’ সড়ক হিসেবে পরিচিত। সবুজে ঘেরা এই সড়কের একটি অংশ গেছে পাহাড় ঘেঁষে ওপর দিয়ে। আরেকটি অংশ নিচে। আর মধ্যবর্তী পাহাড়ি ঢাল, যেটি প্রাকৃতিকভাবে সড়ক বিভাজক হিসেবে গড়ে উঠেছে তাতে রয়েছে ছোট-বড় শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। শতবর্ষী এসব গাছে নানা প্রজাতির পাখিও বাস করে। এখন এই অপরূপ সৌন্দয্যের স্থানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প (গাড়ি ওঠার পথ) নির্মাণ করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য র্যাম্পের দরকার আছে সন্দেহ নেই। এটা নিয়ে আমাদের আপত্তিও নেই। আমাদের আপত্তি হচ্ছে র্যাম্পের কারণে অসাধারণ এই সড়কটি তার সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা হারাবে। শুধু তাই নয় এর কারণে কাটা হবে অনেক গাছ। ইতিমধ্যে গাছগুলোতে লাল ও সাদা কালি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।
র্যাম্প নির্মাণের জন্য গাছ কাটার উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলছেন, যেসব গাছ কাটা যাবে, তার মধ্যে শতবর্ষী গাছ আছে। গাছগুলো রক্ষায় এই অংশে র্যাম্প নির্মাণের দরকার নেই। গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণ করা হলে সড়কের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, রেলওয়ের কর্মকর্তারা পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনা করে অন্য কোথাও র্যাম্প নির্মাণের অনুরোধ করেছিল। তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেছে সিডিএ। রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাতে এমন খবরই জানা গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ ও বন বিভাগ বলছে, এই র্যাম্প নির্মাণ করতে হলে গাছ কাটতে হবে। বন বিভাগ সূত্র জানায়, র্যাম্প নির্মাণের জন্য গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে সিডিএ সম্প্রতি বন বিভাগের কাছে আবেদন করে। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪৬টি গাছ কাটার অনুমতি দেয়। গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে শিরীষ, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, পেয়ারা প্রজাতির গাছ।
গতকাল চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজের সভাপতি দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী ড. অনুপম সেন ও সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলের নেতৃত্বে সর্বস্তরের লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী সিডিএ ভবনে চেয়ারম্যান জহুরুল আলম দোভাষসহ প্রকৌশলী, কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেখানে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ড. অনুপম সেন টাইগারপাসের দ্বিতল সড়কের সৌন্দর্য বজায় রাখার স্বার্থে সেখানে কোনো ধরনের র্যাম্প নির্মাণের বিপক্ষে মত দিয়ে সিডিএ চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ করেন।
এ সময় সিডিএ-এর চেয়ারম্যান বলেন, ‘র্যাম্পের কারণে বড় কোনো গাছ কাটা হবে না, কয়েকটি ছোট গাছ কাটা হতে পারে।’
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। আর তা হলো, টাইগারপাসে দোতলা সড়কে র্যাম্প নির্মাণ খুব জরুরি কিনা। এবং সেটি এই স্থানের বদলে অন্য কোথাও করা যায় কিনা। আমরা গাছ কাটার পক্ষে না থাকলেও এখন বিষয়টি গাছ কাটা না কাটার ওপর নির্ভর করছে না। এই র্যাম্প নির্মাণে একটি গাছ কাটা না হলেও আমরা তার বিরোধিতা করতাম কারণ এই সড়কটির অনন্যতা ও নান্দনিকতার জন্য। পূর্বেও বলেছি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা শত বছর আগের পায়ে চলা পথটিই আজকে এই রূপ পেয়েছে। এটা কোনো কর্তৃপক্ষ তৈরি করেনি। (এক কর্মকর্তা দাবি করেছিলেন এটা সিডিএ করেছে বলে) যা করেছে তা সংস্কার ও আধুনিকায়ন।
গতকালের মতবিনিময় বৈঠকে আমাদের জানানো হলো, টাইগারপাসের আগে-পরে জিইসি মোড় ও আগ্রাবাদেও দুটি ওঠার র্যাম্প হবে। জিইসি থেকে আগ্রাবাদের দূরত্ব মাত্র কয়েক কিলোমিটার। এর মধ্যে তিনটি ওঠার র্যাম্প লাগবে কেন? সিডিএ থেকে বলা হচ্ছে নিউমার্কেট এলাকা থেকে বিপুল যানবাহনের জন্য। প্রকৃত সত্যটা হচ্ছে, যানবাহন এত বিপুল হবে না। কারণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করবে ব্যক্তিগত গাড়ি তথা প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ইত্যাদি, যাদের গন্তব্য হতে পারে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, ইপিজেড, বিমানবন্দর কখনোবা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। এতে পাবলিক বাস, টেম্পু অর্থাৎ গণপরিবহন চলাচলের সুযোগ নেই। তাহলে ভাবতে হচ্ছে, কত শতাংশ মানুষের সুবিধার জন্য আমরা এমন অসাধারণ জায়গাটিকে ইট-পাথরের স্তুপে পরিণত করছি।
আমরা সিদ্ধান্তটি পরিবর্তনের দাবি জানাই। কারণ এ নগরে প্রয়োজনের তুলনায় খোলা স্থান এবং সবুজবীথির অস্তিত্ব কম। আমরা নিজেদের উদ্যোগে গাছের বা উদ্ভিদের সংখ্যা বাড়াতে পারিনি। তার ওপর যদি প্রকৃতি প্রদত্ত সবুজ বেষ্টনী বিনষ্ট করি তাহলে তার জন্য প্রকৃতিও আমাদের ক্ষমা করবে না। আমরা অজস্র টাকা খরচ করে সড়ক দোতলা বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে পারি কিন্তু হাজার কোটি টাকা খরচ করেও কখনো এমন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সড়ক নির্মাণ করতে পারব না।
আমাদের উন্নয়ন দরকার। আমাদের সড়ক দরকার তবে তা কোনোভাবেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে নষ্ট করে নয়।